চীনে ১২ বছর বন্ধ ছিলো উচ্চশিক্ষা
- সময় ০২:৪৮:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪
- / 277
চীনের ইতিহাসে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এক যুগান্তকারী সময় ছিল। মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যার ফলে পুরো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, প্রায় ১২ বছর ধরে বন্ধ ছিল।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীনের লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পুঁজিবাদী প্রভাব দূর করা। মাও সেতুং বিশ্বাস করতেন চীনের শিক্ষাব্যবস্থা বুর্জোয়া চিন্তাধারায় প্রভাবিত, যা বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে বাধা সৃষ্টি করছে। এই বিশ্বাস থেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দিলেন এবং তরুণদের পাঠালেন গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে তারা কৃষি ও শ্রমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করত।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, চীনের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। চীন সরকারের বক্তব্য ছিল, এত ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কি করবে ? কোথায় চাকরি পাবে ? কেই বা চাকরী দিবে ? এত হাজার হাজার বেকারকে চাকরী দেয়ার মত প্রতিষ্ঠান চীনে নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেয়। তরুণদের সরাসরি কৃষি ও শ্রমিক কর্মকান্ডে যুক্ত করা হয়েছিল, যা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। রেড গার্ড আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণরা মাও সেতুংয়ের আদর্শ প্রচারে নিয়োজিত হয় এবং বিরোধী সাংস্কৃতিক মতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
এই সময়টায় চীন ছাত্র-ছাত্রীদের নানা ধরনের ট্রেড কোর্সে কর্মমুখী প্রশিক্ষন দিয়েছিল। স্বল্প মেয়াদী ট্রেড কোর্স শিখে চীনের ছেলে-মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলো। প্রতিটি বাড়ি গড়ে উঠল একটা করে ছোট ছোট কারখানায়। পরিবারের সবাই সেখানে কাজ করে।
বড় ফ্যাক্টরী করার আলাদা খরচ নেই। ফলে পন্যের উৎপাদন খরচ কমে গেলো। বর্তমানে যে কোন পন্য স্বস্তায় উৎপাদন করার যে সক্ষমতা চীনে তৈরি হয়েছে; তা ওই সময়ের প্রশিক্ষণের ফলে।
ওই সময়ের পর পৃৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে চাইনিজ পন্যের প্রসার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে তারা বিশ্ব বানিজ্যের এক অপ্রতিরোধ্য পরাশক্তি হয়ে দাড়ায়। উপযুক্ত মুল্য দিলে তারা এমন জিনিস বানিয়ে দেবে যার গ্যারান্টি আপনি চাইলে ১০০ বছরও দিতে পারবে তারা।
কিন্তু, এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল শিক্ষার মানের অবনতি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে উচ্চশিক্ষার অভাবে চীনের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। একটি প্রজন্ম উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের পেশাগত জীবনে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বুদ্ধিজীবীদের ওপর চালানো হয়েছিল ব্যাপক নিপীড়ন। মাও সেতুং এবং তার সমর্থকরা বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়াশীল ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর ফলে অনেক শিক্ষক ও অধ্যাপককে নির্যাতন সহ্য করতে হয় এবং শিক্ষার মান ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ থাকার ফলে চীনের অর্থনীতিতে সাময়িক উন্নতি হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। শিক্ষার্থীরা শ্রমিক ও কৃষক হয়ে কাজ করলেও প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেয়।
গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়। তরুণরা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করে তাদের জীবনে কিছুটা উন্নতি আনে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
১৯৭৬ সালে মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অবসান ঘটে এবং ধীরে ধীরে চীনের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা চালু হয় এবং শিক্ষাব্যবস্থার মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু হয়।