০৩:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইনকিলাব জিন্দাবাদ: বিপ্লবের ঐতিহাসিক স্লোগান

উৎপল দাস
  • সময় ০৮:১১:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • / 516

ইনকিলাব জিন্দাবাদ: বিপ্লবের ঐতিহাসিক স্লোগান

গেল বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতা পট পরিবর্তনের আগে এবং পরে বহুল আলোচিত স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’এটি মূলত ভারতীয় বিপ্লবীদের দ্বারা ব্যবহৃত হলেও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও এই স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়। যে ধারা অন্তবর্তী সরকারের সময়ও অব্যাহত হয়েছে। বিপ্লবের এই ঐতিহাসিক স্লোগানটি কোথা থেকে এলো, কে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, কার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত রয়েছে, যার মধ্যে “বন্দেমাতরম” ও “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগান দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

“বন্দেমাতরম” স্লোগানটি কংগ্রেসের প্রতিবাদী আন্দোলনের একটি অঙ্গ হয়ে ওঠে। তবে, যখন খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়, তখন মুহাম্মদ আলি জিন্না এটিকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে গ্রহণ করেননি। মহাত্না গান্ধীর সমর্থনে, কংগ্রেস মুসলিম সমাজকে জাতীয় আন্দোলনের অংশীদার করার উদ্দেশ্যে খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু, “বন্দেমাতরম” স্লোগানটির উপর আপত্তি উঠতে থাকে, বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পর, যেখানে স্লোগানটি হিন্দু মূর্তি পূজার প্রতিচ্ছবি হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল। যদিও কংগ্রেসের নেতারা জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জনগনমন” বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস এখনও এই স্লোগানটি ব্যবহার করে আসছে।

এদিকে, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯২১ সালে আমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে, মওলানা হাসরাত মোহানীর মুখে। তিনি স্লোগানটির মাধ্যমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান। এর পটভূমি ছিল রুশ বিপ্লবের প্রতি অনুরাগ, যা তখনকার অনেক ভারতীয়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও মহাত্না গান্ধী অহিংস নীতি এবং কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এই স্লোগানটি সমর্থনযোগ্য ছিল না, তবুও এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে, বিশেষ করে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দ্বারা ১৯২৮ সালে এটি ব্যবহৃত হয়।

মাওলানা হাসরাত মোহানী শুধু একটি স্লোগানই সৃষ্টি করেননি, বরং তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও বিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর জীবন এবং কর্মের প্রভাব এখনও স্মরণীয়, এবং তাঁর নামে আজও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাস এবং কানপুরে একটি হাসপাতাল রয়েছে। উল্লেখ্য, মাওলানা হাসরাত মোহানীর পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ইরানের।

এই দুটি স্লোগান, “বন্দেমাতরম” এবং “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নানা মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ, যা এখনও জাতীয় আলোচনার অংশ হয়ে রয়েছে।

১৯২৯ সালে, ভগত সিং এবং তার সঙ্গী বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা হামলার পর এই স্লোগানটি জনসম্মুখে উচ্চারণ করেন।

১৯২৯ সালের জুনে দিল্লি হাইকোর্টে তাদের বিবৃতির অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো এই স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়। এই ঘটনা স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্লোগানটি ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে।

ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগীরা এই স্লোগানটিকে তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতীকে পরিণত করেন। তারা এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

এই স্লোগানটি পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে এবং এখনও অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার উৎসবগুলিতে ব্যবহৃত হয়।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এবং কমিউনিস্ট একত্রীকরণ এর অফিসিয়াল স্লোগানও ছিল। পাশাপাশি, অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স-এর একটি স্লোগান হিসেবেও ব্যবহৃত হত।

বর্তমানে, এই স্লোগানটি শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান-এও বিভিন্ন বিক্ষোভ, আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকার সংগ্রামে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শিক পটভূমি নির্বিশেষে বিভিন্ন সংগঠন এবং রাজনৈতিক নেতারা এই স্লোগানটি ব্যবহার করে থাকেন।

আজকের দিনে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ একটি শক্তিশালী আন্দোলন এবং প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, যা জনগণের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার চেতনা প্রকাশ করে। এই স্লোগানটির গভীর প্রভাব এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব এখনও অনেক দেশে শোনা যায়, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

শেয়ার করুন

ইনকিলাব জিন্দাবাদ: বিপ্লবের ঐতিহাসিক স্লোগান

সময় ০৮:১১:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

গেল বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতা পট পরিবর্তনের আগে এবং পরে বহুল আলোচিত স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’এটি মূলত ভারতীয় বিপ্লবীদের দ্বারা ব্যবহৃত হলেও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও এই স্লোগানটি জনপ্রিয় হয়। যে ধারা অন্তবর্তী সরকারের সময়ও অব্যাহত হয়েছে। বিপ্লবের এই ঐতিহাসিক স্লোগানটি কোথা থেকে এলো, কে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, কার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত রয়েছে, যার মধ্যে “বন্দেমাতরম” ও “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগান দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

“বন্দেমাতরম” স্লোগানটি কংগ্রেসের প্রতিবাদী আন্দোলনের একটি অঙ্গ হয়ে ওঠে। তবে, যখন খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়, তখন মুহাম্মদ আলি জিন্না এটিকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে গ্রহণ করেননি। মহাত্না গান্ধীর সমর্থনে, কংগ্রেস মুসলিম সমাজকে জাতীয় আন্দোলনের অংশীদার করার উদ্দেশ্যে খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু, “বন্দেমাতরম” স্লোগানটির উপর আপত্তি উঠতে থাকে, বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পর, যেখানে স্লোগানটি হিন্দু মূর্তি পূজার প্রতিচ্ছবি হিসেবে চিত্রিত হয়েছিল। যদিও কংগ্রেসের নেতারা জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জনগনমন” বেছে নিয়েছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস এখনও এই স্লোগানটি ব্যবহার করে আসছে।

এদিকে, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” স্লোগানটি প্রথম উচ্চারিত হয় ১৯২১ সালে আমেদাবাদের কংগ্রেস অধিবেশনে, মওলানা হাসরাত মোহানীর মুখে। তিনি স্লোগানটির মাধ্যমে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান। এর পটভূমি ছিল রুশ বিপ্লবের প্রতি অনুরাগ, যা তখনকার অনেক ভারতীয়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও মহাত্না গান্ধী অহিংস নীতি এবং কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এই স্লোগানটি সমর্থনযোগ্য ছিল না, তবুও এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে, বিশেষ করে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দ্বারা ১৯২৮ সালে এটি ব্যবহৃত হয়।

মাওলানা হাসরাত মোহানী শুধু একটি স্লোগানই সৃষ্টি করেননি, বরং তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও বিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর জীবন এবং কর্মের প্রভাব এখনও স্মরণীয়, এবং তাঁর নামে আজও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্রাবাস এবং কানপুরে একটি হাসপাতাল রয়েছে। উল্লেখ্য, মাওলানা হাসরাত মোহানীর পূর্ব পুরুষরা ছিলেন ইরানের।

এই দুটি স্লোগান, “বন্দেমাতরম” এবং “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নানা মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ, যা এখনও জাতীয় আলোচনার অংশ হয়ে রয়েছে।

১৯২৯ সালে, ভগত সিং এবং তার সঙ্গী বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লির কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা হামলার পর এই স্লোগানটি জনসম্মুখে উচ্চারণ করেন।

১৯২৯ সালের জুনে দিল্লি হাইকোর্টে তাদের বিবৃতির অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো এই স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়। এই ঘটনা স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্লোগানটি ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে।

ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগীরা এই স্লোগানটিকে তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রতীকে পরিণত করেন। তারা এর মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।

এই স্লোগানটি পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পর্কিত হয়ে ওঠে এবং এখনও অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রতিবাদ এবং স্বাধীনতার উৎসবগুলিতে ব্যবহৃত হয়।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। এটি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এবং কমিউনিস্ট একত্রীকরণ এর অফিসিয়াল স্লোগানও ছিল। পাশাপাশি, অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স-এর একটি স্লোগান হিসেবেও ব্যবহৃত হত।

বর্তমানে, এই স্লোগানটি শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান-এও বিভিন্ন বিক্ষোভ, আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকার সংগ্রামে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শিক পটভূমি নির্বিশেষে বিভিন্ন সংগঠন এবং রাজনৈতিক নেতারা এই স্লোগানটি ব্যবহার করে থাকেন।

আজকের দিনে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ একটি শক্তিশালী আন্দোলন এবং প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, যা জনগণের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার চেতনা প্রকাশ করে। এই স্লোগানটির গভীর প্রভাব এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব এখনও অনেক দেশে শোনা যায়, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।