ঢাকা ১০:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ভারতের আজ ৭৬ তম প্রজাতন্ত্র দিবস

সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা

উৎপল দাস
  • সময় ০১:৪০:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
  • / 55

ভারতের ৭৬ তম প্রজাতন্ত্র দিবস

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণকারী মহাকবি আল্লামা ইকবাল লিখেছেন, “সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা, হাম বুলবুলে হে ইসকে, এ গুলসিতাঁ হামারা।

তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের একজন মুসলিম কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার। তার ফার্সি ও উর্দু কবিতাকে আধুনিক ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁকে পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক জনক হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনি নিজের ধর্মীয় ও ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন।

আল্লামা ইকবাল ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ইরানি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি হিসাবে প্রশংসিত। যদিও ইকবাল বিশিষ্ট কবি হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত, তিনি ‘আধুনিক সময়ের মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ’ হিসাবেও অত্যন্ত প্রশংসিত। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আসরার-ই-খুদি ১৯১৫ সালে ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত হয়। কবিতার অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রুমুজ-ই-বেখুদি, পয়গাম-ই-মাশরিক ও জুবুর-ই-আজাম উল্লেখযোগ্য।

ভারতের সংবিধান
ভারতের সংবিধান

১৯২৯-এর বর্ষশেষে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ আনার শপথ ঘোষণার পর; ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভেঙে ভারত যেদিন বাস্তবেই স্বাধীনতার মুখ দেখল- সেইদিন ঘটনাচক্রে ছিল ১৫ অগাস্ট। যার ফলে পালটে গিয়েছিল ২৬ জানুয়ারির গুরুত্বও।

ভারতের ৭৬ তম প্রজাতন্ত্র দিবস আজ। প্রতিবছর দিনটিকে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালন করে ভারত। সারা দেশজুড়ে পালিত হয় নানা কর্মসূচি। দিল্লি, কলকাতাসহ দেশটির নানা প্রদেশের রাজধানীতে চলে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্তি পায় ভারত। কিন্তু তখনও দেশে কোনো স্থায়ী সংবিধান ছিল না। ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পরই একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য গঠিত হয় কমিটি। গঠিত হয় খসড়া সংবিধান। অবশেষে ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি চূড়ান্ত সংবিধান গঠিত হয়। এর দুদিন পর ২৬ জানুয়ারি সারা দেশজুড়ে সংবিধান কার্যকর হয়। তাই আজকের দিনটিতে সারা ভারতজুড়ে পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস।

দিনটি প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেদিন ভারতের নিজস্ব একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারপর থেকে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে এই দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।

ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করেছিল। কিন্তু সে সময় ভারতের নিজস্ব কোনো স্থায়ী সংবিধান না থাকায় ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের সংশোধিত সংস্করণ অনুযায়ী স্বাধীন ভারত শাসিত হতো। ১৯৫০ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ষষ্ঠ এলবার্ট ফ্রেডেরিক আর্থার জর্জ ছিলেন এই দেশের রাজা।

কিন্তু স্বাধীনতার আসল স্বাদ পেতে গেলে দেশবাসীর জন্য প্রয়োজন ছিল নিজস্ব একটি সংবিধান। এই কারণেই স্বাধীনতার ১৩ বছর আগে, ১৯৩৪ সালে দেশের নিজস্ব একটি সংবিধানের দাবিতে এম. এন. রায় সংবিধান সভার দাবি পেশ করেন। এরপর পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুসহ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা লিখিত সংবিধানের জন্য দাবি জানান। তারপর ১৯৪৬ সালে সংবিধান সভা গঠিত হয়। ওই বছরই ৯ ডিসেম্বর সংবিধান তৈরির জন্য প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঠিক তার ২৫০ দিন পর ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে।

ভারতীয়
ভারতীয়

প্রথমে লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন ও পরে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। জওহরলাল নেহেরু হন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

১৯৪৭ সালের ২৮ আগস্ট ভারতের একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. বি. আর. আম্বেদকর। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণপরিষদে জমা হয়। চূড়ান্তভাবে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে দুই বছর ১১ মাস ১৮ দিনব্যাপী গণপরিষদ এই খসড়া সংবিধান আলোচনার জন্য ১৬৬ বার অধিবেশন ডাকে। এই সমস্ত অধিবেশনে জনসাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল। তারপর ড. বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে এবং ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে ২৯৯ জন সদস্যের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর দেশটির সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান ওই দিনেই কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। এবার প্রশ্ন হল, কেন ২৬ জানুয়ারিকেই বেছে নেওয়া হল প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে? কেন অন্য কোনো দিন নয়?

২৯৯ সদস্যের সংবিধান কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজ আনার শপথ ঘোষণার পর ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেই দিনটি সারা ভারতে স্বতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল, তাই সেই দিনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে ভারতের সংবিধান কার্যকরী হয়। সেদিন থেকে আমাদের দেশ প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষ ও রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

নতুন সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে এবং অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। দেশের কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থা বিশেষ উন্নতি লাভ করে। বর্তমানে ভারতে এমন এক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, যাকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মনে করা হয়।

এভাবেই ভারতের সংবিধান সারা বিশ্বের সেরা সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে আমাদের দেশ আর কোনো বিদেশি শক্তিকে ভয় করেনি, কারণ দেশটি নিজেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারি রাজধানী দিল্লির রাজপথে জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস।

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস (ফাইল ফটো)
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস (ফাইল ফটো)

দেশটির প্রজাতন্ত্র হলো এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ বা জনগণের প্রতিনিধি। কোনো রাজা বা রানি এই জাতীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার প্রধানের পদটি পেতে পারেন না। প্রজাতন্ত্র বলতে বোঝায় দেশের প্রধান, যাকে রাষ্ট্রপতি বলা হয়, তিনি বংশগতভাবে নির্বাচিত হবেন না কিংবা সারা জীবনের জন্যও নির্বাচিত হবেন না। তিনি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। একইভাবে তার পরবর্তী পদগুলি, যেমন উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত প্রধান পর্যন্ত সমস্ত পদই পাঁচ বছরের জন্য জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হয়।

সংবিধান মেনে ভারতে ন্যায়, সাম্য, সম অধিকার, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের সার্থকতা বলে মনে করেন দেশটির নাগরিকরা। সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে ভারতকে আরও উন্নততর জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে।

উল্লেখ্য, সুমহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের অনবদ্য অবদানের কারণে একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি হিসাবে আমৃত্যু ঋণ প্রকাশ করে যাবো। দেশটির প্রজাতন্ত্র দিবসে সকল ভারতবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব চিরজীবী হোক।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা অ্যাফেয়ার্স

e-mail: reporterutal7@gmail.com

শেয়ার করুন

ভারতের আজ ৭৬ তম প্রজাতন্ত্র দিবস

সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা

সময় ০১:৪০:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫

পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণকারী মহাকবি আল্লামা ইকবাল লিখেছেন, “সারে জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা, হাম বুলবুলে হে ইসকে, এ গুলসিতাঁ হামারা।

তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের একজন মুসলিম কবি, দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার। তার ফার্সি ও উর্দু কবিতাকে আধুনিক ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁকে পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক জনক হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনি নিজের ধর্মীয় ও ইসলামী রাজনৈতিক দর্শনের জন্যও মুসলিম বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন।

আল্লামা ইকবাল ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, ইরানি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি হিসাবে প্রশংসিত। যদিও ইকবাল বিশিষ্ট কবি হিসাবে সর্বাধিক পরিচিত, তিনি ‘আধুনিক সময়ের মুসলিম দার্শনিক চিন্তাবিদ’ হিসাবেও অত্যন্ত প্রশংসিত। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আসরার-ই-খুদি ১৯১৫ সালে ফার্সি ভাষায় প্রকাশিত হয়। কবিতার অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রুমুজ-ই-বেখুদি, পয়গাম-ই-মাশরিক ও জুবুর-ই-আজাম উল্লেখযোগ্য।

ভারতের সংবিধান
ভারতের সংবিধান

১৯২৯-এর বর্ষশেষে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে ‘পূর্ণ স্বরাজ’ আনার শপথ ঘোষণার পর; ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকেই স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের শিকল ভেঙে ভারত যেদিন বাস্তবেই স্বাধীনতার মুখ দেখল- সেইদিন ঘটনাচক্রে ছিল ১৫ অগাস্ট। যার ফলে পালটে গিয়েছিল ২৬ জানুয়ারির গুরুত্বও।

ভারতের ৭৬ তম প্রজাতন্ত্র দিবস আজ। প্রতিবছর দিনটিকে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে পালন করে ভারত। সারা দেশজুড়ে পালিত হয় নানা কর্মসূচি। দিল্লি, কলকাতাসহ দেশটির নানা প্রদেশের রাজধানীতে চলে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্তি পায় ভারত। কিন্তু তখনও দেশে কোনো স্থায়ী সংবিধান ছিল না। ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পরই একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য গঠিত হয় কমিটি। গঠিত হয় খসড়া সংবিধান। অবশেষে ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি চূড়ান্ত সংবিধান গঠিত হয়। এর দুদিন পর ২৬ জানুয়ারি সারা দেশজুড়ে সংবিধান কার্যকর হয়। তাই আজকের দিনটিতে সারা ভারতজুড়ে পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস।

দিনটি প্রত্যেক ভারতবাসীর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেদিন ভারতের নিজস্ব একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারপর থেকে প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে এই দিনটি পালন করা হয়ে থাকে।

ভারতবর্ষ প্রায় ২০০ বছর ইংরেজদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করেছিল। কিন্তু সে সময় ভারতের নিজস্ব কোনো স্থায়ী সংবিধান না থাকায় ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টের সংশোধিত সংস্করণ অনুযায়ী স্বাধীন ভারত শাসিত হতো। ১৯৫০ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ষষ্ঠ এলবার্ট ফ্রেডেরিক আর্থার জর্জ ছিলেন এই দেশের রাজা।

কিন্তু স্বাধীনতার আসল স্বাদ পেতে গেলে দেশবাসীর জন্য প্রয়োজন ছিল নিজস্ব একটি সংবিধান। এই কারণেই স্বাধীনতার ১৩ বছর আগে, ১৯৩৪ সালে দেশের নিজস্ব একটি সংবিধানের দাবিতে এম. এন. রায় সংবিধান সভার দাবি পেশ করেন। এরপর পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুসহ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা লিখিত সংবিধানের জন্য দাবি জানান। তারপর ১৯৪৬ সালে সংবিধান সভা গঠিত হয়। ওই বছরই ৯ ডিসেম্বর সংবিধান তৈরির জন্য প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঠিক তার ২৫০ দিন পর ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে।

ভারতীয়
ভারতীয়

প্রথমে লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন ও পরে চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। জওহরলাল নেহেরু হন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল হন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

১৯৪৭ সালের ২৮ আগস্ট ভারতের একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. বি. আর. আম্বেদকর। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণপরিষদে জমা হয়। চূড়ান্তভাবে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগে দুই বছর ১১ মাস ১৮ দিনব্যাপী গণপরিষদ এই খসড়া সংবিধান আলোচনার জন্য ১৬৬ বার অধিবেশন ডাকে। এই সমস্ত অধিবেশনে জনসাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিল। তারপর ড. বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে এবং ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে ২৯৯ জন সদস্যের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর দেশটির সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান ওই দিনেই কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। এবার প্রশ্ন হল, কেন ২৬ জানুয়ারিকেই বেছে নেওয়া হল প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে? কেন অন্য কোনো দিন নয়?

২৯৯ সদস্যের সংবিধান কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজ আনার শপথ ঘোষণার পর ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং সেই দিনটি সারা ভারতে স্বতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল, তাই সেই দিনটিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে ভারতের সংবিধান কার্যকরী হয়। সেদিন থেকে আমাদের দেশ প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষ ও রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়া হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

নতুন সংবিধান অনুযায়ী ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটে এবং অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়। দেশের কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থা বিশেষ উন্নতি লাভ করে। বর্তমানে ভারতে এমন এক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, যাকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মনে করা হয়।

এভাবেই ভারতের সংবিধান সারা বিশ্বের সেরা সংবিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে আমাদের দেশ আর কোনো বিদেশি শক্তিকে ভয় করেনি, কারণ দেশটি নিজেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারি রাজধানী দিল্লির রাজপথে জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় প্রজাতন্ত্র দিবস।

ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস (ফাইল ফটো)
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস (ফাইল ফটো)

দেশটির প্রজাতন্ত্র হলো এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যেখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতা ভোগ করে জনগণ বা জনগণের প্রতিনিধি। কোনো রাজা বা রানি এই জাতীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার প্রধানের পদটি পেতে পারেন না। প্রজাতন্ত্র বলতে বোঝায় দেশের প্রধান, যাকে রাষ্ট্রপতি বলা হয়, তিনি বংশগতভাবে নির্বাচিত হবেন না কিংবা সারা জীবনের জন্যও নির্বাচিত হবেন না। তিনি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। একইভাবে তার পরবর্তী পদগুলি, যেমন উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত প্রধান পর্যন্ত সমস্ত পদই পাঁচ বছরের জন্য জনগণের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত হয়।

সংবিধান মেনে ভারতে ন্যায়, সাম্য, সম অধিকার, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়গুলো সুপ্রতিষ্ঠিত করতেই ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের সার্থকতা বলে মনে করেন দেশটির নাগরিকরা। সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে ভারতকে আরও উন্নততর জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে।

উল্লেখ্য, সুমহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের অনবদ্য অবদানের কারণে একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি হিসাবে আমৃত্যু ঋণ প্রকাশ করে যাবো। দেশটির প্রজাতন্ত্র দিবসে সকল ভারতবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব চিরজীবী হোক।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা অ্যাফেয়ার্স

e-mail: reporterutal7@gmail.com