সাগরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বাবুর ফোরস্টার বাহিনী
- সময় ১২:৩৯:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫
- / 101
ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালীর উত্তরাঞ্চলসহ কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চলের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে যুবলীগ নেতা ৩৫ মামলার পলাতক আসামী আখতারুজ্জামান বাবু। তারা চার সহোদর মিলে গড়ে তুলেছে বিশাল সশস্ত্র ক্যাড়ার বাহিনী । স্থানীয়রা নাম দিয়েছেন ফোরস্টার বাহিনী। মহারাজা বাবু কালারমারছড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হলে ও বর্তমানে তার অপকর্মের আশ্রয়ে রয়েছেন মহেশখালী উপজেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতা।
কারণ তার ভাই আনিসুল ইসলাম ছোটন কালারমারছড়া ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক, অপর ভাই জাহেদুল ইসলাম রিপন ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সভাপতি ও রব্বানী নামের আরেক ভাই জামায়াত কর্মী। এই চার সহোদর কালারমারছড়া ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের উত্তর নলবিলা আফজলিয়া পাড়ার মৃত সমির জালাল কালুর ছেলে।
মহেশখালীর কালারমারছড়া, হোয়ানক,শাপলাপুর, ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, পেকুয়ার মগনামা, উজানটিয়া,হরিয়ার দিয়া,চকরিয়ার বদরখালী,কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় অঞ্চলে হত্যা,জলদূস্যতা, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ছিনতাই, জমি দখল, সন্ত্রাস ও ধর্ষণের মতো যত অপকর্ম হয় সবকিছুতেই বাবু ও তার ভাইদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর খুবই দাপটের সাথে রাজকীয় জীবন যাপন করেছে আখতারুজ্জামান বাবু ও তার ক্যাড়ার বাহিনী। ৫ আগষ্ট পট পরিবর্তনের পর যুবলীগ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় চালাতে থাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও জলদস্যুতা। একের পর দখল করতে থাকে অসংখ্য চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠের জমি। এভাবে বাবু উপকূলীয় অঞ্চলের এক মূর্তিমান আতংকের নামে পরিণত হয়। এমনকি তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার মত সাহস কেউ রাখেনা।
মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের উত্তর নলবিলার এনামুল হক বলেন, আমার চিংড়ি ঘের দীর্ঘদিন ধরে বাবু বাহিনী দখল করে নিয়েছে। আমি বাবুসহ তার বাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছি। তবুও চিংড়িঘের দখলমুক্ত করতে পারিনি। উল্টো আমার বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করে যাচ্ছে। আমার মতো অসংখ্য লোকের জমিজমা পেশী ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ভোগদখল করছে বাবু বাহিনী। বদরখালী বাজারের ব্যবসায়ী শামসুল আলম বলেন, বাবু বাহিনীর চাঁদাবাজিতে অতিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সময়মত চাঁদা দিতে না পারলে পরিকল্পিত ভাবে চালানো হয় লুটতরাজ।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্প এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে রাস্তায় ব্যরিকেড দিয়ে কয়েকদফা সশস্ত্র চেষ্টা চালিয়েছে বাবুবাহিনী। প্রকল্পের কয়েক কোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়েছে বাবু ও তার বাহিনীর লোকজন। লুট করেছে ৬২ কার্টুন টাইলস। ৪০ লক্ষ টাকার লোহার রড়। এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে মহেশখালী থানায়। অর্ধ কোটি টাকার বৈদ্যুতিক তার পাচারকালে সম্প্রতি জব্দ করেছেন নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড। এ ঘটনায় বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারো তারা চার ভাই মিলে বিশাল বাহিনী গঠন করে পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে সাগরে জলদস্যুতা,সমতলে জমি দখল, চাঁদাবাজি ছিনতাই, লুটপাট ও প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে জনমনে ভীতির সৃষ্টি করছে। ফলে উত্তর মহেশখালীসহ কক্সবাজার উত্তরাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদের আতংকের নাম আখতারুজ্জামান বাবু।
মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কায়ছার হামিদ বলেন, বাবুর বিরুদ্ধে তিন ডজন মামলা আছে। তার ভাইদের বিরুদ্ধে ও দুই ডজনের কাছাকাছি মামলা আছে। মহেশখালী থানা থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে তাদের বাড়ি। যখনই পুলিশের অভিযান চালানো হয়, কোন না কোন ভাবে বাবু বাহিনী খবর পেয়ে যায়। তখন তারা অবস্থান নেয় পাহাড়ের গহীন অরণ্যে। ফলে বারবার পুলিশী অভিযান ব্যর্থ হচ্ছে। তার পর ও আমরা এসব সন্ত্রাসীদের গতিবিধির উপর নজর রাখছি।তারা যত বড় অস্ত্রধারী বাহিনী হোক ধরা তাদের পড়তেই হবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ অভিযান চালিয়ে থানায় ফেরার পূর্বেই আখতারুজ্জামান বাবু আমাকে ফোন দিয়ে বলে কেন বারবার আমার বাড়িতে অভিযান চালান? আমি কী সন্ত্রাসী না ডাকাত।
বাবু বাহিনীর সর্বশেষ ঘটনা :
পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়ার করিয়ারদিয়া লম্বাঘোনায় লবণ চাষীদের উপর গত ১৮ জানুয়ারি বাবু বাহিনীর সশস্ত্র হামলায় ১১ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এ সময় পুলিশের অভিযানে বাবু বাহিনীর একজন সদস্যকে আটক করা হয়েছে।
করিয়ারদিয়ার মাঝের চর লম্বাঘোনায় আকতারুজ্জামান বাবুর নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি সশস্ত্র বাহিনী লবণ চাষীদের উপর ১০-১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ১১ জন আহত হন।
আহতদের মধ্যে রয়েছেন বদরখালীর নাসির উদ্দিন, জসিম উদ্দিন সরকার, সালাহউদ্দিন সাকা, দেলোয়ার, জসিম উদ্দিন, দিলু আহমদ, বারেক মিয়া, জামাল উদ্দিন, বদর উদ্দিন, আবদুর রহিম এবং নুরুন্নবী।
পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বাবু বাহিনীর সদস্য মাতারবাড়ী ইউনিয়নের মো. হোসেনের ছেলে সাদেক হোসেন খোকাকে আটক করেছে। পুলিশ জানায়, বাবু বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে লবণ চাষ ও মৎস্য প্রজেক্ট থেকে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করে আসছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাবু বাহিনী প্রায় ২০০ একর লবণ মাঠের চাষীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছে। অভিযুক্ত আকতারুজ্জামান বাবুর বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ও ভোটকেন্দ্র দখলসহ ৩৫টি মামলা রয়েছে। তার ভাই আনিসুল ইসলাম ছোটন ও জাহেদুল ইসলাম রিপনের বিরুদ্ধেও ২০টি করে মামলা রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দুর্গম দ্বীপে বাবু বাহিনীর আস্তানা থাকায় প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। ফলে দীর্ঘ ১৫ বছর ত্রাসের রাজত্ব ধরে রেখে তারা লবণ মাঠ, সাগর ও মৎস্য প্রজেক্টে দস্যুবৃত্তি চালিয়ে আসছে।
পেকুয়া থানার ওসি মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা বলেন, “বাবু বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে তদন্তে গেলে পুলিশের উপস্থিতিতেই তারা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। একজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাদাবী, অস্ত্র আইন চাষীদের উপর গুলি বর্ষণ ও কুপিয়ে আহত করার অপরাধে পৃথক দুটি মামলায় শতাধিক লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুটি মামলায় প্রধান আসামী করা হয়েছে আখতারুজ্জামান বাবুকে।