গান্ধীকেও সাংবিধানিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি
সংবিধানে স্বীকৃতি নেই ‘শেখ মুজিব জাতির পিতা’!
- সময় ০৫:৩৬:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
- / 87
১৯৭১ সালে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ নামে যে দেশটির জন্ম হয়েছে; তার রূপকার কে? অন্তত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ‘শেখ মুজিবুর রহমানের’ নামটিই এক কথায় বলা হতো। তাকেই বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে মেনে নেয়া হতো।
৫ আগস্টের পর দেশে এখন নতুন দৃশ্যপট। আওয়ামী বিরোধীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে। বিভিন্ন স্থান থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও ছবি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। বিতর্ক তৈরি হয়েছে জাতির পিতা স্বীকৃতি নিয়েও।
কেন এই মতানৈক্য? পৃথিবীর অন্যান্য দেশ স্বাধীনতার সংগ্রামী নেতাদের সংবিধানে গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জাতির পিতা’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই কেন?
স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কোনো একক ব্যক্তির সর্বোচ্চ অবদানকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ‘জাতির পিতা’ বা ‘স্থপতি’ বা ‘জনক’ বা ‘জাতির অভিভাবক’ হিসেবে নানা উপাধি প্রদান করা হয়। যেসব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একাধিক ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সেসব রাষ্ট্রে কয়েকজনকে ‘ফাউন্ডিং ফাদার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়ে অনেক বিতর্কের যেমন অবসান ঘটেছে; তেমনি নতুন নতুন অনেক বিষয়ে সংবিধানে সংস্কার হয়েছে। কিন্তু জাতির পিতার বিষয়টি কেন সুরাহা করা হয়নি।
গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক শহীদুল্লাহ ফরায়জীর মতে, স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘জাতীয় পতাকা’ ও ‘জাতীয় সংগীত’ নির্ধারিত হলেও ‘জাতির পিতা’ প্রশ্নে কাউকে নির্ধারণ করা হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে মর্যাদা দেয়া এবং ঘোষণা করার কথা বলা হয়েছিল।
পরবর্তীতে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরও আওয়ামী লীগ কখনো সাংবিধানিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে সাংবিধানিকভাবে মর্যাদাদানের বিষয়েও আওয়ামী লীগের কোনো ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের প্রতিফলন হয়নি।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করা হয়নি, তেমনি স্বাধীনতার পর ’৭২ সালেও জাতির পিতা তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথাও সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়নি।
যদিও বিশ্বের বহু সংবিধানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের অপরিসীম অবদানের কথা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে। ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া ও তুরস্ক-সহ অনেক দেশের সংবিধানে জাতি বা রাষ্ট্র গঠনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সংগ্রামী পুরুষদের অবদান স্বীকার করে তাঁদের প্রতি সাংবিধানিক মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছে।
আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে- ’৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদ বিতর্কে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ বা সংবিধানের প্রস্তাবনায় তাঁর নাম উত্থাপনের জন্য কেউ দাবি উত্থাপন করেননি। গণপরিষদ বিতর্কে বা বিশ্লেষণে জোরালো বা গভীরভাবে কেউ বঙ্গবন্ধুর অবদানের জন্য সাংবিধানিক মর্যাদা দেয়ার তাগিদও দেয়নি।
’৭২-এর ১১ই জানুয়ারি থেকে ’৭৩-এর ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ২০০ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল তখনো বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ কিংবা তাঁর প্রতিকৃতি সংরক্ষণের কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি।
’৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন অবিসংবাদিত নেতা তখন এবং তারপর ’৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।
বাংলাদেশে ‘জাতির পিতা’ নির্ধারণ বিষয়ে সাংবিধানিকভাবে আজও কোনো আইন হয়নি, তবে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংরক্ষণের আইন হয়েছে!
তবে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতির পিতা বা ‘বাপুজি’ মহাত্মা গান্ধীকেও কিন্তু সাংবিধানিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি। যদিও দেশটির সর্বস্তরের মানুষ তাকেই জাতির পিতা হিসেবে মানেন।