যতবার অভিযান চালাবে, ততবারই আগুনের ধোঁয়া

- সময় ০৫:০৫:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / 47
যতবার প্রশাসন অভিযান চালাবে, ততবারই ইটভাটাগুলোতে আগুনের ধোঁয়া বের হবে। প্রশাসন অভিযানে যে জরিমানা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো টাকা তুলতে হবে—লস তো হতে দেব না। এমন ভাষ্য এখন অবৈধ ইটভাটা মালিকদের মুখে মুখে। প্রশাসন একাধিকবার অভিযান চালানোর পরও এখনো থামছে না অবৈধ ইটভাটা কার্যক্রম। বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়িসহ চার উপজেলায় অবৈধ ইটভাটা চালানোর হিড়িক পড়েছে ইটভাটা মালিকদের মধ্যে। ফলে আশপাশের বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে, গাছগাছালি ধ্বংস হচ্ছে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় যতগুলো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে, সেগুলো বন্ধের জন্য হাইকোর্ট থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যেগুলো চলমান রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রায় লক্ষাধিক টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবুও থামানো যাচ্ছে না এসব অবৈধ ইটভাটা। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে নতুন ভূমি আইনসহ পার্বত্য এলাকায় ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবানের ৭০টি অবৈধ ইটভাটার মধ্যে প্রায় ২৫টি চালু রয়েছে। ফাইতং ইউনিয়নে ১৪টি, গজালিয়ায় ১টি, ফাঁসিয়াখালীতে ১টি, ছাগলখাইয়ায় ১টি, আলীকদমে ২টি এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৬টি। বান্দরবানের সাতটি উপজেলার মধ্যে লামা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা কার্যক্রম চলছে, বিশেষ করে ফাইতং ইউনিয়নে। সেখানে প্রায় ১৪টি অবৈধ ইটভাটা চালু রয়েছে। একই চিত্র আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাতেও। এই দুই উপজেলায় মিলে প্রায় ৮টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এসব ইটভাটায় প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পরিবেশ অধিদপ্তর একাধিকবার অভিযান চালানোর পরপরই আবারো ধোঁয়া বের হয়, মাথা তুলে দাঁড়ায় অবৈধ ইটভাটার চুল্লি। শুরু হয় ইট তৈরির কাজ, গাছ কাটার মহোৎসব এবং পাহাড় কেটে ধ্বংসযজ্ঞ। জরিমানা করার বদলে এসব ইটভাটার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশ সচেতন মহল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লামা উপজেলায় প্রবেশের মুখেই স্বপন নামে এক ইটভাটায় চলছে ইট পোড়ানো ও তৈরির কাজ। সেখানে প্রায় এক রাউন্ড (এক লাখের বেশি) ইট তৈরি করা হয়েছে। লামার ফাইতং ইউনিয়নে পুরোদমে চলছে ইট পোড়ানোর কাজ। প্রতিটি ইটভাটার চুল্লি থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া। পাহাড়ের কোলে রাখা হয়েছে অসংখ্য গাছের লাকড়ির ডিপো এবং চলছে মাটি কাটার কাজ। তাছাড়া ওই এলাকার ফাইতং-বানিছড়া সড়কের অবস্থা নাজেহাল। ধুলাবালিতে প্রতিটি এলাকা সাদা হয়ে গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লামার ফাইতং ইউনিয়নের প্রতিটি অবৈধ ইটভাটায় বনাঞ্চল উজাড় করে গাছ সরবরাহ দিচ্ছেন মুক্তার মেম্বার নামে এক ব্যক্তি। অপরদিকে, অর্থ লেনদেনসহ বিভিন্ন বিষয় সামাল দিচ্ছেন মুজিব, মহিউদ্দিন, মুক্তারসহ আরও কয়েকজন ব্যক্তি। তাছাড়া প্রতিটি ইটভাটা মালিক প্রশাসন ও হাইকোর্ট থেকে রিট এনে ইটভাটা চালু করেছেন বলে দাবি করছেন। অন্য ইটভাটা মালিকরাও দায় এড়াতে একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঝিকঝাক ইটভাটার মালিক মোহাম্মদ কবির হোসেন বলেন, “আমরা হাইকোর্ট থেকে রিট এনে ইটভাটা চালাচ্ছি। অবৈধভাবে কিছু করছি না। প্রতিটি ইটভাটা রিট নেওয়া।” হাইকোর্ট থেকে রিটের কাগজ দেখতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি কেন দেখাব? যাকে দেখাতে ইচ্ছে হবে, তাকেই দেখাব।”
ইটভাটা মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুক্তার মেম্বার বলেন, “এখন আমার কোনো দায়িত্ব নেই। সব দায়িত্ব মহিউদ্দিন, মজিব, কবির নিয়েছে। তারাই লেনদেন করছে।”
অভিযানের পর আবারও ইটভাটা চালু করা হয় কেন—এমন প্রশ্ন করা হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, “অভিযানের পর ইটভাটা মালিকরা আবার চালু করলে আমাদের আর কী করার আছে! তবে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে যৌথভাবে অভিযান চালানো হচ্ছে এবং জরিমানাও করা হচ্ছে। এই অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
এ বিষয়ে বান্দরবান জেলা প্রশাসক শামিম আরা রিনি বলেন, “প্রতিটি ইটভাটায় উপজেলা প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করছে। অভিযান শেষে আবারো ইটভাটা চালু করছে ইটভাটা মালিকরা। আর প্রতিটি ইটভাটা দুর্গম এলাকায় হওয়ায় অভিযান পরিচালনা করা কঠিন। তাছাড়া জরিমানা করার দায়িত্ব প্রশাসনের, আর গুঁড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। আমরা সেনাবাহিনীর মাধ্যমে অভিযান পরিচালনার চেষ্টা করছি।”
শামিম আরা রিনি আরও বলেন, “পরিবেশ রক্ষার্থে নতুন ভূমি আইন তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে অবৈধ ইটভাটা মালিকদের মামলার আওতায় আনা হবে। আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার জন্য। আর মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”