ঢাকা ০৬:৫৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
নিন্দা ও প্রতিবাদ

বেগম রোকেয়ার মুখে কালি, লালন ফকিরে আঘাত

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • সময় ০২:১২:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
  • / 29

বেগম রোকেয়া লালন

৫ আগস্ট বাংলাদেশের পট পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হয়েছে নানামূখী অপচেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনের দেয়ালে ‘বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ’ খ্যাত বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতি’র চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন ওই হলেরই একজন শিক্ষার্থী। একই সাথে নারায়ণঞ্জে নরসিংহপুরে স্থানীয় মুসল্লি ও বিভিন্ন ইসলামি দলের বাধার মুখে দুই দিনব্যাপী ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত

গত ১৯শে নভেম্বর বিকেলের দিকে বেগম রোকেয়ার মুখে কালির ঘটনাটি সামনে আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেন, যা এখনও চলছে। ঘটনার পরদিনই ওই হলের শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে হলের প্রাধ্যক্ষ’র গোচরে এনেছিলেন। পরে তিনি স্নাতোকোত্তর পড়ুয়া ওই নারী শিক্ষার্থীকে ডাকেন।

ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে তার কাজের জন্য ক্ষমা চান ও পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মাঝে গ্রাফিতিটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও শেষ পর্যন্ত গ্রাফিতিটি তার ঠিক করার প্রয়োজন পড়েনি। নির্ধারিত সময়ের আগেই ঢাবি’র চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা তা ঠিক করে দিয়েছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে, যিনি সবার কাছে বেগম রোকেয়া নামেই বেশি পরিচিত, ঘিরে এমন আরও একটি ঘটনা এই সাম্প্রতিক সময়েই ঘটেছে।

কয়েকদিন আগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।

ইতোমধ্যে এ বিষয়ক একটি স্মারকলিপিতে গণস্বাক্ষর করে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর জমাও দিয়েছেন তারা। যদিও নাম পরিবর্তনের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব যুক্তি রয়েছে।

কিন্তু এই দু’টো ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে চাইছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, এই দু’টো ঘটনাই আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ও ধর্মীয় রাজনীতির বাড়াবাড়ির ফলাফল।

গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার লালন মেলা ও সাধুসঙ্গ উপলক্ষে কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাধু-গুরু ও লালন-ভক্তরা নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় মেলা পরিচালনার অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘লালন মেলা আয়োজন নিয়ে স্থানীয় মসজিদের ইমাম, মুসল্লি ও বিভিন্ন ইসলামি দলের তীব্র আপত্তি আছে। এ জন্য তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন চাইলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা আছে বলে পুলিশ প্রতিবেদন দেয়। এ জন্য মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।’

লালনে আঘাত
লালনে আঘাত

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর মধ্য নরসিংহপুর এলাকায় মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে এ লালন মেলার আয়োজন করা হয়। এবারও মেলা আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল আশ্রম কর্তৃপক্ষ। সেই উপলক্ষে প্যান্ডেল তৈরিসহ নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৫ নভেম্বর মেলা বন্ধের দাবিতে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে মধ্য নরসিংহপুর এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এদিন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল এই মেলাকে ইমানবিধ্বংসী আখ্যা দিয়ে প্রতিহত করার ঘোষণা করেন। ওই নেতার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ২০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেন মুক্তিধাম আশ্রমের লোকজন ও নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা।

মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ফকির শাহ্ জালাল জানান, প্রকাশ্যে তাঁকেসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লালন সাধু-গুরু-ভক্তদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের এখানে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। নাজেহাল করে ফিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এখানে মারামারি করার জন্য আসিনি। আমরা তো শান্তি চাই।’

লালন ফকির
লালন ফকির

এদিকে, নরসিংহপুর বাইতুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘এই মেলায় ইমানবিধ্বংসী কাজ হয়। সেখানে নাচ-গানসহ অনৈসলামিক কার্যক্রম চলে। ওই মেলা প্রতিহত করা সবার ইমানি দায়িত্ব।’

ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। লালন-ভক্তদের যাতে কেউ ক্ষতি না করতে পারে, সে জন্য তাদের নিরাপত্তায় সেখানে পুলিশ দেওয়া হয়েছিল।’

তবে এমন ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেন লালন-ভক্তরা। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীরাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা রফিউর রাব্বি গণমাধ্যমে বলেন, ‘লালন মেলা বন্ধ করার জন্য যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হুংকার দিয়েছে, প্রশাসন সেটাতে আপসরফা করেছে। কুষ্টিয়ার লালন-ভক্তদের নাজেহাল করে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রশাসনের এমন অবস্থানের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’

 

শেয়ার করুন

নিন্দা ও প্রতিবাদ

বেগম রোকেয়ার মুখে কালি, লালন ফকিরে আঘাত

সময় ০২:১২:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

৫ আগস্ট বাংলাদেশের পট পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হয়েছে নানামূখী অপচেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনের দেয়ালে ‘বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ’ খ্যাত বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতি’র চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন ওই হলেরই একজন শিক্ষার্থী। একই সাথে নারায়ণঞ্জে নরসিংহপুরে স্থানীয় মুসল্লি ও বিভিন্ন ইসলামি দলের বাধার মুখে দুই দিনব্যাপী ‘মহতী সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা’ বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানকার মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত

গত ১৯শে নভেম্বর বিকেলের দিকে বেগম রোকেয়ার মুখে কালির ঘটনাটি সামনে আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেন, যা এখনও চলছে। ঘটনার পরদিনই ওই হলের শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে হলের প্রাধ্যক্ষ’র গোচরে এনেছিলেন। পরে তিনি স্নাতোকোত্তর পড়ুয়া ওই নারী শিক্ষার্থীকে ডাকেন।

ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী মৌখিকভাবে ও লিখিতভাবে তার কাজের জন্য ক্ষমা চান ও পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মাঝে গ্রাফিতিটি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। যদিও শেষ পর্যন্ত গ্রাফিতিটি তার ঠিক করার প্রয়োজন পড়েনি। নির্ধারিত সময়ের আগেই ঢাবি’র চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা তা ঠিক করে দিয়েছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে, যিনি সবার কাছে বেগম রোকেয়া নামেই বেশি পরিচিত, ঘিরে এমন আরও একটি ঘটনা এই সাম্প্রতিক সময়েই ঘটেছে।

কয়েকদিন আগে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) নাম পরিবর্তন করে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ করার দাবি জানিয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।

ইতোমধ্যে এ বিষয়ক একটি স্মারকলিপিতে গণস্বাক্ষর করে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর জমাও দিয়েছেন তারা। যদিও নাম পরিবর্তনের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব যুক্তি রয়েছে।

কিন্তু এই দু’টো ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখতে চাইছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, এই দু’টো ঘটনাই আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ও ধর্মীয় রাজনীতির বাড়াবাড়ির ফলাফল।

গতকাল শুক্রবার ও আজ শনিবার লালন মেলা ও সাধুসঙ্গ উপলক্ষে কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাধু-গুরু ও লালন-ভক্তরা নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় মেলা পরিচালনার অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘লালন মেলা আয়োজন নিয়ে স্থানীয় মসজিদের ইমাম, মুসল্লি ও বিভিন্ন ইসলামি দলের তীব্র আপত্তি আছে। এ জন্য তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন চাইলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা আছে বলে পুলিশ প্রতিবেদন দেয়। এ জন্য মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।’

লালনে আঘাত
লালনে আঘাত

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর মধ্য নরসিংহপুর এলাকায় মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে এ লালন মেলার আয়োজন করা হয়। এবারও মেলা আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল আশ্রম কর্তৃপক্ষ। সেই উপলক্ষে প্যান্ডেল তৈরিসহ নানা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৫ নভেম্বর মেলা বন্ধের দাবিতে ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে মধ্য নরসিংহপুর এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। এদিন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুল আউয়াল এই মেলাকে ইমানবিধ্বংসী আখ্যা দিয়ে প্রতিহত করার ঘোষণা করেন। ওই নেতার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে ২০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করেন মুক্তিধাম আশ্রমের লোকজন ও নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা।

মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ফকির শাহ্ জালাল জানান, প্রকাশ্যে তাঁকেসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লালন সাধু-গুরু-ভক্তদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের এখানে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। নাজেহাল করে ফিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এখানে মারামারি করার জন্য আসিনি। আমরা তো শান্তি চাই।’

লালন ফকির
লালন ফকির

এদিকে, নরসিংহপুর বাইতুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘এই মেলায় ইমানবিধ্বংসী কাজ হয়। সেখানে নাচ-গানসহ অনৈসলামিক কার্যক্রম চলে। ওই মেলা প্রতিহত করা সবার ইমানি দায়িত্ব।’

ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে মেলা আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। লালন-ভক্তদের যাতে কেউ ক্ষতি না করতে পারে, সে জন্য তাদের নিরাপত্তায় সেখানে পুলিশ দেওয়া হয়েছিল।’

তবে এমন ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেন লালন-ভক্তরা। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীরাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা রফিউর রাব্বি গণমাধ্যমে বলেন, ‘লালন মেলা বন্ধ করার জন্য যে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি হুংকার দিয়েছে, প্রশাসন সেটাতে আপসরফা করেছে। কুষ্টিয়ার লালন-ভক্তদের নাজেহাল করে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রশাসনের এমন অবস্থানের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’