ঢাকা ০৩:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
যুবরাজ থেকে একনায়ক

বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

নিউজ ডেস্ক
  • সময় ০৫:৩২:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / 40

সিরিয়ার পদত্যাগী প্রেসিডেন্ট বাশার

মধ্যপ্রাচ্যের এক সময়ের অন্যতম শক্তিশালী দেশ সিরিয়া। তবে আজকের সিরিয়া যুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ আর মানবিক সংকটের আরেক নাম। ৫৪ বছরের একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে যখন বাশার আল আসাদ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন, যখন সিরিয়া একটি নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হলো।

১৯৭০ সালে হাফেজ আল আসাদ, বাশারের বাবা, সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সিরিয়ার বাথ পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং সামরিক বাহিনীতে তার শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। তার শাসন ছিল কেন্দ্রীভূত এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। হাফেজ আল আসাদের হাত ধরে সিরিয়ায় বাথ পার্টির শাসনযুগ শুরু হয়, যা একাধারে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা এবং ভয়াবহ দমননীতির প্রতীক হয়ে ওঠে।

হাফেজ আল বাশার
হাফেজ আল আসাদ

১৯৮২ সালে হামা শহরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিদ্রোহ দমনে তার আদেশে যে গণহত্যা চালানো হয়, তাতে ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনা তার শাসনের এক কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা রয়েছে।

২০০০ সালে হাফেজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতার মসনদে বসেন তার পুত্র বাশার আল আসাদ। পেশায় একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ বাশারকে প্রথমে একজন সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হলেও, ক্ষমতায় আসার পর তিনি তার পিতার মতোই কঠোর নীতি অনুসরণ করেন।

বাশারের শাসনের শুরুর দিকটা ছিলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে ভরা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি অল্পদিনেই মিথ্যে প্রমাণিত হয়। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে কাঁপিয়ে তুলছিল, সিরিয়ার জনগণও তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিতে পথে নামেন।

আসাদের শাসনামলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। বিশেষত, সাধারণ মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ এবং বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচনা করার দাবি তুলেছে।

আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার শাসনের বিরোধিতাকারী জনগোষ্ঠী এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক নীতি গ্রহণ করেছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার সরকার পরিচালিত কারাগারগুলোতে বন্দিদের ওপর চরম নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে।

সিরিয়া আসাদ
সিরিয়ার বাশার আল আসাদ

২০১৩ সালের গৌতা হামলায় সিরিয়া সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। সিরিয়া সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক তদন্তে প্রমাণ মেলে যে সরকারই এই হামলার জন্য দায়ী।

বাশার আল আসাদ নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রতিটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিকৃত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিরোধী দল এবং স্বাধীন মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করে জনগণের বাকস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছেন।

আসাদের সরকার ইরান এবং রাশিয়ার সরাসরি সহায়তায় টিকে আছে। সমালোচকদের মতে, এই বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা সিরিয়ার সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করেছে এবং দেশকে একটি কৌশলগত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে।

বাশার পতনের মাস্টারমাইন্ড জোলানি
বাশার পতনের মাস্টারমাইন্ড জোলানি

সমালোচকরা দাবি করেন, আসাদের শাসনকালে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে। এর ফলে অঞ্চলটি এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হয়েছে। আসাদের শাসনের কারণে সিরিয়ার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধ, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে দেশটির জনগণ চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়েছে।
বাশার আল আসাদের পতনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা চালান বাশার। অন্যদিকে, বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত বাহিনী তাকে চাপে রাখে।

২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর, সিরিয়ার জনগণের এক দীর্ঘ সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক চাপে অবশেষে পদত্যাগ করেন বাশার আল আসাদ। তবে তার পতন সিরিয়ার জন্য মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে কিনা, তা নিয়ে আজও প্রশ্ন রয়েছে।

শেয়ার করুন

যুবরাজ থেকে একনায়ক

বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

সময় ০৫:৩২:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

মধ্যপ্রাচ্যের এক সময়ের অন্যতম শক্তিশালী দেশ সিরিয়া। তবে আজকের সিরিয়া যুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ আর মানবিক সংকটের আরেক নাম। ৫৪ বছরের একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে যখন বাশার আল আসাদ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেন, যখন সিরিয়া একটি নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হলো।

১৯৭০ সালে হাফেজ আল আসাদ, বাশারের বাবা, সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করেন। তিনি সিরিয়ার বাথ পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং সামরিক বাহিনীতে তার শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। তার শাসন ছিল কেন্দ্রীভূত এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। হাফেজ আল আসাদের হাত ধরে সিরিয়ায় বাথ পার্টির শাসনযুগ শুরু হয়, যা একাধারে সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা এবং ভয়াবহ দমননীতির প্রতীক হয়ে ওঠে।

হাফেজ আল বাশার
হাফেজ আল আসাদ

১৯৮২ সালে হামা শহরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিদ্রোহ দমনে তার আদেশে যে গণহত্যা চালানো হয়, তাতে ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনা তার শাসনের এক কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা রয়েছে।

২০০০ সালে হাফেজ আল আসাদের মৃত্যুর পর ক্ষমতার মসনদে বসেন তার পুত্র বাশার আল আসাদ। পেশায় একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ বাশারকে প্রথমে একজন সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হলেও, ক্ষমতায় আসার পর তিনি তার পিতার মতোই কঠোর নীতি অনুসরণ করেন।

বাশারের শাসনের শুরুর দিকটা ছিলো সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে ভরা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি অল্পদিনেই মিথ্যে প্রমাণিত হয়। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে কাঁপিয়ে তুলছিল, সিরিয়ার জনগণও তখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দাবিতে পথে নামেন।

আসাদের শাসনামলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। বিশেষত, সাধারণ মানুষের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ এবং বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচনা করার দাবি তুলেছে।

আসাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তার শাসনের বিরোধিতাকারী জনগোষ্ঠী এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনমূলক নীতি গ্রহণ করেছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার সরকার পরিচালিত কারাগারগুলোতে বন্দিদের ওপর চরম নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে।

সিরিয়া আসাদ
সিরিয়ার বাশার আল আসাদ

২০১৩ সালের গৌতা হামলায় সিরিয়া সরকারের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। সিরিয়া সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক তদন্তে প্রমাণ মেলে যে সরকারই এই হামলার জন্য দায়ী।

বাশার আল আসাদ নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রতিটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিকৃত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিরোধী দল এবং স্বাধীন মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করে জনগণের বাকস্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করেছেন।

আসাদের সরকার ইরান এবং রাশিয়ার সরাসরি সহায়তায় টিকে আছে। সমালোচকদের মতে, এই বহিরাগত শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা সিরিয়ার সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করেছে এবং দেশকে একটি কৌশলগত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে।

বাশার পতনের মাস্টারমাইন্ড জোলানি
বাশার পতনের মাস্টারমাইন্ড জোলানি

সমালোচকরা দাবি করেন, আসাদের শাসনকালে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছে। এর ফলে অঞ্চলটি এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত হয়েছে। আসাদের শাসনের কারণে সিরিয়ার অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধ, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে দেশটির জনগণ চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়েছে।
বাশার আল আসাদের পতনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। রাশিয়া ও ইরানের সমর্থনে ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা চালান বাশার। অন্যদিকে, বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত বাহিনী তাকে চাপে রাখে।

২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর, সিরিয়ার জনগণের এক দীর্ঘ সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক চাপে অবশেষে পদত্যাগ করেন বাশার আল আসাদ। তবে তার পতন সিরিয়ার জন্য মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে কিনা, তা নিয়ে আজও প্রশ্ন রয়েছে।