বান্দরবানের যেখানে পর্যটক নিষিদ্ধ!
- সময় ০৪:৫৮:২১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪
- / 281
বান্দরবান জুড়েই দর্শনীয় অনেক স্থান আছে। এগুলোর একটির চেয়ে অন্যটি আরও সুন্দর। বান্দরবান গেলেই প্রকৃতির অপার বিস্ময়ে নয়ন জুড়াবে আপনার। তবে জানেন কি, বান্দরবানের অন্যতম সেরা এক দর্শনীয় স্থান হলো আন্ধারমানিক। যেখানে পর্যটকদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে, বান্দরবান জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত আন্দারমানিক। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর রহস্যময়তা নিয়ে এই অঞ্চল সবসময় আকর্ষণীয়। কিন্তু এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর এলাকা সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ।
বান্দরবান জেলার থানছি উপজেলার বড় মদক এলাকায় অবস্থিত আন্ধারমানিক। বড় মদকের পর আর কোনো সেনা বাহিনী বা বিজিবি ক্যাম্প নেই। এ কারণে নিরাপত্তার খাতিরে আন্ধারমানিকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। এর পেছনে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক ও নিরাপত্তাজনিত কারন রয়েছে।
বান্দরবানের মতো পাহাড়ি অঞ্চলগুলো বরাবরই দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি- সবকিছু মিলিয়ে এই অঞ্চল ভিন্নধর্মী। কিন্তু এই সৌন্দর্যের পেছনে লুকিয়ে আছে নানা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত জটিলতা। আন্দারমানিক এলাকাটির অবস্থান এর কারণেই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
আন্দারমানিক এলাকা কেন পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ? এর উত্তর খুঁজতে গেলে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এই অঞ্চল আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও পাহাড়ি নেতাদের সাথে দেশের মূলধারার সরকারের সম্পর্ক একধরনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক জটিলতা, বিশেষ করে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে শান্তিচুক্তির আগের সময়টাতে, এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও স্পর্শকাতর ছিল। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও বাঙালি সেটেলারদের মধ্যে বিবাদ, ভূমি অধিকার নিয়ে সংঘাত এবং সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি – সব মিলিয়ে এই এলাকা সংঘাতময় হয়ে ওঠে।
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি অনেক সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছে বটে, তবে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি আনতে পারেনি। আন্দারমানিক অঞ্চলের আশপাশে এখনো কিছু সংঘাতের শঙ্কা রয়েছে, যার কারণে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ থেকেই সরকার এই এলাকাকে পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ করেছে।
এছাড়া স্থানীয় আদিবাসী নেতারা মনে করেন, বাইরের লোকদের আনাগোনা তাদের সংস্কৃতি এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের আশঙ্কা, পর্যটনের মাধ্যমে ভূমি দখল এবং বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
আন্দারমানিক এলাকায় বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস, বিশেষ করে ম্রো, মারমা এবং চাকমা। তাদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি বহুদিন ধরে এই অঞ্চলের পরিবেশের সাথে জড়িত। এখানকার মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ বজায় রেখেই জীবন ধারণ করে। আধুনিক সমাজের সাথে তাদের সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে দূরত্ব বজায় রেখেছে।
সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গিতে, আন্দারমানিক এলাকা এখনও নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পার্বত্য অঞ্চলে নানা উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ও অপরাধী সংগঠন এখনো সক্রিয়, যারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে। এই কারণেই এলাকাটিকে সামরিকভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আন্দারমানিক এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের খুব কাছেই অবস্থিত। মায়ানমার সীমান্তে এই এলাকা অত্যন্ত সংবেদনশীল, যা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য একটি উদ্বেগের কারণ। সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও কাঠ পাচার, মাদক ব্যবসা এবং সীমান্ত সংঘাতের ঝুঁকি এই অঞ্চলের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলেছে।
তবুও থেমে নেই পর্যটকরা। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের অন্ধকারে ঢুকে পড়ছে পর্যটকরা। যারা রোমাঞ্চ প্রিয় কেবল তারাই আন্ধারমানিকে যাওয়ার সাহস দেখান।
আন্ধারমানিকের মূল আকর্ষণ হলো নারেসা ঝিরি। এর দুই পাশ প্রায় ৬০/৭০ ফুট পাথরের দেওয়াল। যা সমান্তরাল ভাবে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। মনে হবে কংক্রিটের ঢালাই দেয়া হয়েছে দু’পাশের পাহাড়ি দেওয়ালে। এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয় সেখানে।
আন্ধারমানিক সত্যিই অন্ধকারে ঢাকা। দিনের বেলাতেও অন্ধকার, ভুতুড়ে পরিবেশ। সূর্যের আলো কম পৌঁছানোর কারণে স্থানটি সবসময় অন্ধকার থাকে।