পুনর্নির্মাণ দাবি সাংস্কৃতিক সংগঠনের
নেত্রকোনার মহুয়া অডিটরিয়াম এখন আবর্জনার মাঠ
- সময় ০৯:৫৯:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
- / 24
হাওর জনপদ সাহিত্য ও সংস্কৃতির উর্বর ভূমি নেত্রকোনা জেলা শহরের মোক্তার পাড়া সড়কে অবস্থিত জেলা শিল্পকলা একাডেমির একমাত্র অডিটরিয়াম মহুয়া অডিটরিয়ামে আজ শুধুই ঘাস আর ময়লা আবর্জনার মাঠ। এক সময়ের উৎসব মূখর প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে ফেলার পর রাজনৈতিক কারণ আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় মুখ থুবড়ে পড়েছে এর পুনর্নির্মাণ কাজ। অথচ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন ও অনুশীলনের জন্য এটির নির্মাণ দীর্ঘদিনের দাবি এলাকার সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সচেতন মহলের।
মহুয়া,মলুয়া, কৃষ্ণ লীলা, জারি,উরি,সারি, ভাটিয়ালি গান ও বিয়ের আসরে ধামাইল গানের জন্য পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনা দেশের সংস্কৃতির অঙ্গনে এক মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। জেলা শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অন্তত ত্রিশের বেশি সরকারি বেসরকারি সাংস্কৃতিক সংগঠন ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান।এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও শিল্পীদের সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপক অনুশীলন ও অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য নেই আলোকসজ্জায় সজ্জিত আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশের উপযুক্ত কোন অডিটরিয়াম।
এপার বাংলা ওপার বাংলার জননন্দিত লেখক বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, রবীন্দ্রনাথের গানের সুরকার উস্তাদ শৈলজারঞ্জন মজুমদার,খালকদাদ চৌধুরী,সদ্য প্রয়াত দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ, উপমহাদেশের প্রখ্যাত বংশীবাদক বাউল বারী সিদ্দিকী,প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার, কলামিস্ট জাফর ইকবাল, লোকগাথার জনপ্রিয় বাউল শিল্পী কুদ্দুছ বয়াতি, অন্ধ সিরাজ উদ্দিনসহ অসংখ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী, গবেষক ও প্রেমিকের জন্মস্থান এই নেত্রকোনা জেলা।
জেলা শহরের অজহর রোডে অবস্থিত জেলা উদীচি শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যালয়,তেরীবাজার রোডে প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠী, মোক্তার পাড়া দুর্বার গোষ্ঠী, মিতালী, শতদল,শেকড়, নেত্রকোনা সাহিত্য সমাজ, বাউল সমিতি, রশিদ উদ্দিন একাডেমি,কচিকাঁচা একাডেমি।সাতপাই কেডিসি গোডাউন রোডে রয়েছে বেশ কয়েকটি যাত্রা শিল্পীদের সাজঘর। নবীন শিল্পীদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি আধুনিক সঙ্গীত চর্চার ব্যাণ্ড শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যালয়। মোক্তার পাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত পাবলিক হল ছাড়া আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন তেমন কোন অডিটরিয়াম নেই বললেই চলে।
অডিটরিয়াম না থাকায় বিভিন্ন জাতীয় উৎসব পরিবেশন তেমন কোন পরিবেশ নেই জেলা শহরে। ঐতিহাসিক মোক্তার পাড়া মাঠের একপাশে ছিল পালা কাহিনীর নায়িকা মহুয়ার নামে মহুয়া অডিটরিয়াম। এখানে আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৭৯সালে তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল এটি। যেখানে উৎসব মূখর পরিবেশে পরিবেশন করা হত গান , বাজনা, নাটক, নৃত্যসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কালক্রমে পুরাতন হয়ে যাওয়ার পর এটি সংস্কার করার জন্য ভেঙ্গে ফেলে হয়।
আজ সেই মহুয়া অডিটরিয়াম শুধুমাত্র একটি ময়লা আবর্জনার মাঠ। চারদিকে বিভিন্ন ধরনের ময়লা আবর্জনার ছড়াছড়ি। পায়খানা প্রস্রাবের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ। ময়লায় ভরপুর এক বিশ্রী অবস্থা বিরাজ করছে। দেখে মনেই হয় না একসময় এখানে বিশাল মহুয়া অডিটরিয়াম ছিল, ছিল জেলা শহরের সবচেয়ে বড় ও সুবিধা সম্বলিত এক মনোরম অডিটরিয়াম। যেখানে বিভিন্ন জাতীয় উৎসবসহ সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত, অগণিত মানুষের ঢল নামতো পুরো অডিটরিয়ামে।সে শুধুই স্মৃতি হয়ে পড়ে আছে।
জেলা শহরের মোক্তার পাড়া সড়কের পাশে অবস্থিত পাবলিক হল ছাড়া আর কোন ভবন নেই যেখানে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সুযোগ আছে। এখানেও অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য নেই আলোকসজ্জায় সজ্জিত আধুনিক মঞ্চসহ প্রযুক্তি ও উপযুক্ত লাইটিং কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ।নেই নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য মিউজিক উপকরণ,গ্ৰীনরুমসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। যখন একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে চায় তখন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাদের।স্থান সংকুলান হয় না অগণিত মানুষের। অনেকেই সিটের অভাবে দাঁড়িয়ে থাকে পেছনে কিংবা বারান্দায়। অনেকেই বসতে না পেরে চলে যায় অনুষ্ঠান না দেখেই।
তাই আজ মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। জেলা শহরের সংস্কৃতি চর্চা ও অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য এর কোন বিকল্প নেই। সংস্কৃতি চর্চা ও বিনোদনের অভাবে যুবসমাজ আসক্ত হয়ে পড়ছে মদ মাদকতায়। বেড়ে চলেছে রাস্তা ঘাটে অপ্রয়োজনীয় আড্ডা, ইভটিজিংসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। মহুয়া অডিটরিয়ামের আশেপাশে ও নিয়মিত বখাটে ছেলে মেয়ে আড্ডা জমায় ।এসব দূর করতে প্রয়োজন এ যুগের যুব সমাজের জন্য আধুনিক বিনোদন, বিশুদ্ধ সঙ্গীত,নূত্য, নাটকের মতো অনুষ্ঠান পরিবেশনের উপযুক্ত পরিবেশ ও স্থান। একটি আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি সম্পন্ন অডিটরিয়াম একমাত্র এ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হতে পারে বলে জেলার সংস্কৃতি কর্মী ও গবেষকদের দাবি।
জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বার বার মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ নিয়ে দাবি তুলেছেন। তিনি জানান, জেলা শহরের সংস্কৃতি চর্চা, অনুশীলন ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য একটি অডিটরিয়াম অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অনেক সংগঠন তাদের অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য কোন স্থান না পাওয়ার তাদের কর্মকাণ্ড অচল হয়ে পড়েছে। অচিরেই মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ করে হারানো দিনের গৌরব ফিরে পাবে এমনটি দাবি দীর্ঘদিনের ।
বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সভাপতি শামীম তালুকদার বলেন, জেলা শহরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার জন্য মহুয়া অডিটরিয়ামের বিকল্প নেই। সমস্ত দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এড়িয়ে চলুন এটি নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করি। সচেতন মহল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের এ জন্য এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি।যাতে মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ করে একটি সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ আবারো জেলা শহরের আনাচে কানাচে জেগে ওঠে।
জানতে চাইলে জেলা শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তা তাপস ঘোষ জানান, তিনি বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তবে মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ হবে এ নিয়ে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।এর প্রক্রিয়া চলমান আছে।পোরসভার সংস্কৃতি কর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন।একদিন মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ সফল হবে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, বিষয়টি সম্পর্কে জেনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মহুয়া অডিটরিয়াম নির্মাণ করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করবে।