তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে এতো বিতর্ক কেন?
- সময় ১০:১৩:৫০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
- / 58
সম্প্রতি সংবিধান সংস্কারসহ একগুচ্ছ প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। একই প্রস্তাব তৈরি করেছে জামায়াতসহ আরো কয়েকটি দলও।
তাদের সংস্কার প্রস্তাবনায় রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করার সুপারিশ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার – বাংলাদেশের রাজনীতির এক বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। এমন একটি ব্যবস্থা, যা একসময় দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে ভূমিকা রেখেছিল, আজ তা নিয়েই প্রশ্ন ও বিতর্কের অন্ত নেই। কেন এই ব্যবস্থা নিয়ে এত বিতর্ক?
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে। সেই সময় জাতীয় পার্টির শাসনের অবসান এবং বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা আসে। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া সরকার ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে প্রণয়ন করে। কিন্তু ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্দেশ্য ছিল – নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনকালে একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মূলত এমন একটি সমাধান হিসেবে এসেছিল, যা দলীয় সরকারের প্রভাব এড়িয়ে জনগণকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া উপহার দিতে পারত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোও প্রকাশ পেতে শুরু করে।”
১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চারটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০০৭-২০০৮ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। তাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
২০০৮ সালের পরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এই সিদ্ধান্ত আবার নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। বিরোধী দল বিএনপি এই ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তনের দাবি তোলে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই দেশে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মানেই তা হবে প্রহসন।”
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অতীতে অনেক অপব্যবহার হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, এখন জনগণের নির্বাচিত সরকারই নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করবে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার অভাব। বিরোধী দল বিশ্বাস করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা নিরপেক্ষ হবে না। অপরদিকে, ক্ষমতাসীন দল মনে করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করলে আবারো অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ও বিপক্ষে থাকা যুক্তিগুলো একে আরও জটিল করে তুলেছে। পক্ষে থাকা মানুষদের মতে, এই ব্যবস্থা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। বিপক্ষে থাকা মানুষরা বলছেন, এটি একটি অগণতান্ত্রিক ধারণা, যা সংবিধানের মূল চেতনার বিপরীতে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এটি একটি অস্থায়ী সমাধান ছিল, যা বিশেষ পরিস্থিতিতে কাজ করেছিল। তবে এর বিকল্প কী হবে, সেটি নিয়েই আজও সঠিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কি আবার ফিরে আসবে? নাকি এর পরিবর্তে নতুন কোনো সমাধান খুঁজে পাবে বাংলাদেশ? এ প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।