টিউলিপ ইস্যুতে আওয়ামী লীগ কিছুই বলবে না
- সময় ০৩:৫৩:৪০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারি ২০২৫
- / 21
সময়ের চর্চিত চরিত্রের নাম টিউলিপ সিদ্দিক। ক্ষেত্র বিশেষে বাংলাদেশের অন্য ইস্যুর চেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছেন যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে। তবে বঙ্গবন্ধুর নাতনির ইস্যুটি নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটির একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে বলেছেন, টিউলিপ সিদ্দিক আমাদের অহংকার। ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে তার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো খন্ডন তিনি নিজেই করতে পারেন। তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো পদেই ছিলেন না কখনো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাতনি হিসাবে আওয়ামী লীগও চায়, সুষ্ঠ তদন্তদের মাধ্যমে বেরিয়ে আসুক প্রকৃত তথ্য। তবে মানসিকভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে টিউলিপ সিদ্দিকের প্রতি যেন ন্যায় বিচার হয়, সেটা প্রত্যাশা করে বলেও জানিয়েছেন ভারতে অবস্থানরত একজন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সঙ্গে টিউলিপ সিদ্দিকের বিষয়টি নিয়ে নেত্রী (শেখ হাসিনা) কোনো নির্দেশনা দেননি। তাই আমরাও বিষয়টি খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনে করে, বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ আইন রয়েছে, সেখানে মোকাবিলা করবেন টিউলিপ সিদ্দিক। কিন্তু বাংলাদেশের কতিপয় মানুষ যারা বঙ্গবন্ধু পরিবারের কাউকে না কাউকে যেকোনো সময় বিব্রত করতে চায়। এই পরাজিত শক্তির সঙ্গে টিউলিপ একাই লড়াই করে জিতে আসবেন বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ এসেছে টিউলিপ সিদি বিরুদ্ধে। তিনি সাহস ও ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত তিনি মোকাবিলা করছেন। এমন সময় নতুন করে তাকে নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুধু ড. ইউনূসই নন, টিউলিপকে নিয়ে কথা বলেছেন কনজারভেটিভ পার্টি ও টোরি পার্টির সদস্যরা। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ঘটেছে, বাংলাদেশে এসে টিউলিপের মতোই বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আরেক ব্রিটিশ এমপি রূপা হক।
ব্রিটিশ মন্ত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের দিকে ইঙ্গিত করে রূপা হক বলেন, আমার এক সহকর্মী সম্পর্কে ব্রিটিশ সংসদে দুর্নীতিসংক্রান্ত কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের অর্থ। আমাদের যুক্তরাজ্যে দুর্নীতিসংক্রান্ত আইন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে অনেক কারণে এসব আইনের প্রয়োগ নেই। তবে এগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে, বিতর্ক সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনী ও শেখ রেহানার কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক তাঁর সহজাত ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে সঁপে দিলেন নিজেকে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তিনি নিজেকে তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে সঁপে দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত এমন একাধিক সম্পত্তিতে বসবাস বা ভোগদখল করছেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নগর ও দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রীদের মানদণ্ড নির্ণয়বিষয়ক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তের অনুরোধ করেছেন। বিশেষ করে, ব্রিটিশ মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত নীতিমালা বা আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন কি না, তা টিউলিপ খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করেছেন লরি ম্যাগনাসকে।
টিউলিপ সিদ্দিক এমন এক সময়ে অনুরোধ করলেন, যখন তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর খালা ও বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্ত ব্রিটেনে অবস্থিত একাধিক সম্পত্তিতে বসবাস করার অভিযোগ উঠেছে। হাসিনা সম্প্রতি ব্যাপক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য (ইউকে) শাখা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে।
স্টারমার যখন শ্যাডো ক্যাবিনেটে ছিলেন তখন আওয়ামী লীগের ইউকে শাখার প্রতিনিধিরা তার জন্য ‘তহবিল সংগ্রহের’ নৈশভোজের আয়োজনও করেছিলেন।
শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের খালা এবং বর্তমানে তিনি ভারতে আছেন।
লন্ডনে ‘বিনা মূল্যে ফ্ল্যাট’ ও বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপ সিদ্দিক বর্তমানে ব্যাপক চাপের মধ্যে আছেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এবার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে নিয়ে এমন চাঞ্চল্যকর খবর এলো।
ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখা দেশটিতে এখনও সক্রিয় আছে এবং পূর্বে টিউলিপ সিদ্দিকের পক্ষেও প্রচারণা চালিয়েছে।
টেলিগ্রাফ বলছে, ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কর্মী আবদুল আহাদ চৌধুরী স্টারমারের পক্ষে তার হলবর্ন এবং সেন্ট পানক্রাস নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালিয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার কর্মীরা স্টারমারের পক্ষে লেবার পার্টির লিফলেট বিতরণ করেছে ও সেইসঙ্গে প্লাকার্ড নিয়ে স্টারমারের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। তারা ধারাবাহিকভাবে টিউলিপের পক্ষেও প্রচারণা চালিয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সিনিয়র কর্মকর্তা শাহ শামীম আহমেদ এবং সৈয়দ শাজিদুর রহমান ফারুক একই সময় টিউলিপের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে বলে টেলিগ্রাফে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া স্টারমার আবদুল আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা করেছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন স্টারমার।
আওয়ামী লীগের কর্মীরা এই অনুষ্ঠানকে স্টারমারের জন্য অর্থ সংগ্রহের নৈশভোজ হিসেবে উল্লেখ করেছে। গত বছরের জুলাইতে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের দিন একটি ছবি পোস্ট করেন আবদুল আহাদ। সেখানে স্টারমারের সঙ্গে তাকে কর্মমর্দন করতে দেখা গেছে। তবে কবে এই ছবি তোলা হয়েছে তা নিয়ে কিছু জানা যায়নি।
এ ছাড়া ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচনী প্রচারণার সময় স্টারমারের সঙ্গে আবুদল শদীহ শেখের একটি ছবি দেখা যায়। আবদুল শহীদ শেখ নিজেকে আওয়ামী লীগের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিতেন।
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া, যুক্তরাজ্যের একটি ফ্ল্যাট উপহার পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
লন্ডনের কিং’স ক্রস এলাকায় অবস্থিত ওই ফ্ল্যাটটি ২০০৪ সালে বাংলাদেশি ডেভেলপার আবদুল মোতালিফ টিউলিপকে উপহার দেন বলে জানা গেছে। এই ফ্ল্যাটটি ২০০১ সালে মাত্র ১ লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ডে কেনা হলেও একই এলাকায় একই সময়ে অন্যান্য ফ্ল্যাটের মূল্য ছিল প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। এই ফ্ল্যাট থেকে বর্তমানে টিউলিপ বছরে ৯০ হাজার পাউন্ড আয় করছেন বলে জানা যায়।
এসব অভিযোগ ওঠার পর ব্রিটেনের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির (টোরি) সদস্যরা টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ দাবি করেছেন। টোরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান সরাসরি তার সম্পত্তি লেনদেনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “টিউলিপ যদি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হন, তবে তার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়া উচিত নয়।”
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এখনো টিউলিপের প্রতি আস্থা রাখার কথা বলেছেন। তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস জানিয়েছে, টিউলিপের পরিবর্তে অন্য কাউকে সিটি মিনিস্টার পদে বসানোর জন্য শর্টলিস্ট তৈরি করা হয়েছে। যদিও ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের মুখপাত্র এই খবরে অসত্য বলে দাবি করেছেন।
এদিকে, যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শনিবার (১১ জানুয়ারি) সানডে টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘লন্ডনে টিউলিপ সিদ্দিকের সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত এবং যদি প্রমাণ হয় শেখ হাসিনা সরকারের সময় যে ব্যাপকভাবে লুটপাট হয়েছে সেখান থেকে তিনি সুবিধা পেয়েছেন, তাহলে তাকে বিচারের জন্য দেশে ফেরত পাঠানো উচিত।’
ড. ইউনূস সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেছেন, এ বিষয়ে টিউলিপের ক্ষমা চাওয়া উচিত। যদিও টিউলিপ সিদ্দিক নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন। কোনও ধরনের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর মিনিস্ট্রিয়াল স্ট্যান্ডার্ডসের ইন্ডিপেনডেন্ট অ্যাডভাইজার লাউরি ম্যাগনাসের কাছে নিজের বিরুদ্ধে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন। স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি দাবি করেছেন, ‘আমি কোনও ভুল করিনি।’