ঢাকা ০২:০৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এশিয়ায় সর্বেোচ্চ সুদের হার বাংলাদেশে

জিম্বাবুয়ের পথে বাংলাদেশ !

বিশেষ প্রতিনিধি
  • সময় ১০:৪২:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪
  • / 61

এশিয়ায় সর্বোচ্চ সুদের হার বাংলাদেশে

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে চলছে এক চরম সংকটকাল। দেশজুড়ে বেড়েছে সুদের হার। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি এবং প্রায় আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের সমপর্যায়ে।

গত কয়েক মাসে দেশের অনেক ব্যাংক নগদ টাকার তীব্র সংকটে ভুগছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তারা উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহে বাধ্য হয়েছে।

স্বল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে গ্রাহকদের। তাদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের আর্থিক পণ্যও বাজারে এনেছে ব্যাংকগুলো। সরকারি দপ্তরগুলো থেকেও আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

এই পরিস্থিতি তৈরির কারণ খুঁজতে গেলে কিছুটা পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০২০ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় তফসিলি ব্যাংকগুলোর ঋণ এবং আমানতের ওপর সুদের হার ক্যাপ

করার একটি নীতি গ্রহণ করে। এতে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ ঋণ এবং ৬ শতাংশ আমানতের সীমার মধ্যে পরিচালিত হয়।

কিন্তু চলতি বছর, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ শর্তের কারণে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারের এই সীমা তুলে নেয়। ফলে, ঋণের সুদ দ্রুত বেড়ে ওঠে।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি সুদের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের ছোট-বড় সব ধরনের ঋণগ্রহীতার ওপর।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্থনীতির অগ্রগতি প্রায় অসম্ভব। উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।

এতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে।”

প্রবৃদ্ধির হার, যা এক বছর আগেও ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বর্তমানে নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশে।

এই প্রভাব শুধু যে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানে পড়ছে তাই নয়। দেশের নির্মাণ খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ও এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গত এক বছরে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সঙ্কটে পড়ে অনেকেই ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ছে। ব্যবসার জন্য ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে।

ফলে  অনেক উদ্যোক্তা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে। যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্যও অশনিসংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা
ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, “ঋণ পাওয়া তাদের জন্য এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ব্যাংকগুলো যে সুদ নিচ্ছে, তাতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।”

কিছু ব্যাংক তাদের আমানতের ওপর ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রদান করছে।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষও নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে।

ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে অনেকে দারিদ্র্যের দিকে ঝুঁকছে।

একই সঙ্গে, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হারও লাগামহীন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ছাড়াই বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্বভাবে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে।

ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের প্রেক্ষিতে তাদের বেতন বা ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ সুদের হার ঋণগ্রহীতাদের জন্য প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আর্থিকখাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, “বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে, বাংলাদেশ কি জিম্বাবুয়ের পথে হাঁটছে! যে উপসর্গগুলো জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে দেখে দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে।”

জিম্বাবুয়ের মতোই বাংলাদেশেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের সংকট, এবং ঋণের উচ্চ সুদ অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বর্তমান অবস্থায় নতুন উদ্যোগ গ্রহণ, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ ব্যাহত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে যখন এ ধরনের সংকট তৈরি হয়, তখন একটি সুদৃঢ় এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

শেয়ার করুন

এশিয়ায় সর্বেোচ্চ সুদের হার বাংলাদেশে

জিম্বাবুয়ের পথে বাংলাদেশ !

সময় ১০:৪২:০৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে চলছে এক চরম সংকটকাল। দেশজুড়ে বেড়েছে সুদের হার। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি এবং প্রায় আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের সমপর্যায়ে।

গত কয়েক মাসে দেশের অনেক ব্যাংক নগদ টাকার তীব্র সংকটে ভুগছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য তারা উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহে বাধ্য হয়েছে।

স্বল্প সময়ে বড়লোক হওয়ার প্রলোভন দেখাচ্ছে গ্রাহকদের। তাদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের আর্থিক পণ্যও বাজারে এনেছে ব্যাংকগুলো। সরকারি দপ্তরগুলো থেকেও আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

এই পরিস্থিতি তৈরির কারণ খুঁজতে গেলে কিছুটা পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০২০ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় তফসিলি ব্যাংকগুলোর ঋণ এবং আমানতের ওপর সুদের হার ক্যাপ

করার একটি নীতি গ্রহণ করে। এতে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ ঋণ এবং ৬ শতাংশ আমানতের সীমার মধ্যে পরিচালিত হয়।

কিন্তু চলতি বছর, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ শর্তের কারণে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারের এই সীমা তুলে নেয়। ফলে, ঋণের সুদ দ্রুত বেড়ে ওঠে।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি সুদের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের ছোট-বড় সব ধরনের ঋণগ্রহীতার ওপর।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্থনীতির অগ্রগতি প্রায় অসম্ভব। উচ্চ সুদের কারণে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।

এতে দেশের মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে।”

প্রবৃদ্ধির হার, যা এক বছর আগেও ছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বর্তমানে নেমে এসেছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশে।

এই প্রভাব শুধু যে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানে পড়ছে তাই নয়। দেশের নির্মাণ খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ও এতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গত এক বছরে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সঙ্কটে পড়ে অনেকেই ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ছে। ব্যবসার জন্য ব্যয় বহুগুণে বেড়ে গেছে।

ফলে  অনেক উদ্যোক্তা ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে। যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্যও অশনিসংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা
ঝুঁকিতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, “ঋণ পাওয়া তাদের জন্য এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ব্যাংকগুলো যে সুদ নিচ্ছে, তাতে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।”

কিছু ব্যাংক তাদের আমানতের ওপর ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রদান করছে।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষও নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে।

ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে অনেকে দারিদ্র্যের দিকে ঝুঁকছে।

একই সঙ্গে, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হারও লাগামহীন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ছাড়াই বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্বভাবে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে।

ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের প্রেক্ষিতে তাদের বেতন বা ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ সুদের হার ঋণগ্রহীতাদের জন্য প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আর্থিকখাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, “বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে, বাংলাদেশ কি জিম্বাবুয়ের পথে হাঁটছে! যে উপসর্গগুলো জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে দেখে দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে।”

জিম্বাবুয়ের মতোই বাংলাদেশেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের সংকট, এবং ঋণের উচ্চ সুদ অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

বর্তমান অবস্থায় নতুন উদ্যোগ গ্রহণ, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ ব্যাহত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে যখন এ ধরনের সংকট তৈরি হয়, তখন একটি সুদৃঢ় এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।