গোপালগঞ্জ পরিচয়ে দায়মুক্তি, গড়েছেন সম্পদের পাহাড়
- সময় ০৫:০৮:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 388
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দীন আহমেদ। বাড়ি গোপালগঞ্জ। বারবার অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরও; ‘গোপালগঞ্জ’ পরিচয় তাকে এনে দিয়েছে দায়মুক্তি। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
২০১২ সালে তিনি নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার পদে নিয়োগ পান। অভিযোগ রয়েছে, ওই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার মতো প্রয়োজনীয় যোগ্যতা তার ছিলো না। এমনকি পরীক্ষার আবেদনে যে স্বাক্ষর রয়েছে, সেটিও তার না।
অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। সে তদন্ত এখনো চলমান। এক দশকেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। সেখানে নেয়ামক হিসেবে কাজ করেছে ‘গোপালগঞ্জ’ পরিচয়।
ক্ষমতার দাপটে বিগত বছরগুলোতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে একাই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কন্ট্রোলার অব এডুকেশন, প্রিন্সিপাল অফিসার ও সবশেষে চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের চলতি দায়িত্বও তার হাতেই রয়েছে।
এসব পদে থেকে তার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ কোস্টাল, ফিশারিজ, এবং বিদেশগামী জাহাজের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে কয়েক লাখ টাকা আয় করার অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইনের লঙ্ঘন করে বিভিন্ন দেশের নেভিগেশন সার্টিফিকেট অবৈধভাবে জারি করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
তার দেওয়া সার্টিফিকেট অব ইকুইভ্যালেন্স ইন্দোনেশিয়ার নেভিগেশন সনদ ইস্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। এছাড়া পানামা, বেলিজ, ফিলিপাইন, এবং মালয়েশিয়ার নেভিগেশন সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে গিয়াসউদ্দীনের বিরুদ্ধে। তাছাড়া, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে মোট ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও উঠেছে।
তার মাসিক বেতন তিন হাজার ইউএস ডলার বা সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি। ডলারের বর্তমান বাজার রেট হিসেব করলে তার বেতন থেকে আয় পুরো চাকরিজীবনে ৫ কোটি টাকার কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু এই বেতনের বিপরীতে তার সম্পদের ফিরিস্তি শুনে যে কারো চোখ ছানাবড়া হওয়ার কথা।
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের ৬৭ নম্বর ইস্টার্ন ডালিয়া এ/৪ রয়েছে ২৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট। যার আনুমানিক মুল্য ৫ কোটি টাকা। ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের ৬৭ নম্বর বাড়ি (বিশ্বাস ক্রিডেন্স) ডি/৪ ৩৬০০ স্কয়ার ফিটের আরেকটি ফ্লাট। যেটির বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৭ কোটি। একই রোডে ৩১ নম্বর বাসা রেজাস ড্রিম সি/৩ এ ২৪শ’ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাট, যেটির বাজার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা। ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়ির (মির অনিকা ইয়াকুব কমার্শিয়াল টাওয়ার) দ্বিতীয় তলায় প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার ১২শ’ স্কয়ার ফিটের আরো একটি ফ্লাট।
খিলগাঁও প্রধান সড়কের সাথে র্যাংস ভবনে ২৫শ’ স্কয়ার ফিটের (এ/৮/৯ ফ্ল্যাট), যার বাজার মূল্য পাঁচ কোটি। উত্তরা স্বপ্নধারা হাউজিং, রোড নম্বর ৬, বাসা ৪৬/৩ ২৪শ’ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট; যেটির বাজার মূল্য আনুমানিক দুই কোটি ৮৮ লাখ। উত্তরা ইস্টার্ন হাউজিং, রোড নম্বর ৬, সেক্টর নম্বর ৪, উত্তরা বাসা এ/৭ ও জি বি ডি এল পার্ক রোড নাম্বার ২ সেক্টর নাম্বার ৭ বাসা ৪৬/৩ উত্তরায় সমমূল্যের আরো দুটি ফ্ল্যাট। ডমিনো, ডি/৮ রোড নাম্বার-৩ সেক্টর ১১ উত্তরাতে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার আরো একটি ফ্ল্যাট। ডিওএইচএস মিরপুরে বাসা নম্বর-৬, রোড নাম্বার এ/৩ এলাকায় ১ কোটি ৬০ লাখ মুল্যের ২২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। পূর্বাচল মেরিন সিটি চুড়াইল গাজীপুর ঢাকাতে ৫ কাঠার প্লট। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ই ব্লকে ৫ কাঠার প্লট তার স্ত্রী সাজেদার মালিকানায় চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে রয়েছে ওশান মেরিটাইম একাডেমি এবং জালিয়াতির কারণে বন্ধ হওয়া ওজিমা মেরিন একাডেমির ৫১ শতাংশ শেয়ার ছিলো তার।
তার আয় এবং সম্পদের এমন তারতম্য নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সেখানে তিনি মাসিক বেতন ৩ হাজার ইউএস ডলারের পাশে অতিরিক্ত একটি শুন্য যোগ করে ৩০ হাজার ইউএস ডলার দেখিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার সাথে আঁতাত করারও অভিযোগ উঠে এ নিয়ে। সেখানেও তাকে ‘গোপালগঞ্জ’ পরিচয় বিশেষ সুবিধা এনে দেয়।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার লোহাইড় গ্রামের গ্রাম্য চিকিৎসক মজিবর রহমানের সন্তান গিয়াসউদ্দীন। ৮৮ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি শেষে ১৯৯২ সালে মেরিন ফিশারিজ চট্টগ্রাম নেভিগেশন শেষে মাস্টার হিসেবে চাকুরী শুরু করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, গিয়াসউদ্দীন চাকরীতে যোগদানের আগে তার পরিবারের লোহাইড় গ্রামে তিন বিঘা সম্পদ ছিলো। তা এখন বেড়ে কয়েক হাজার বিঘায় দাঁড়িয়েছে। নিজগ্রাম লোহাইড়ে গড়ে তুলেছেন ছয় তলার আলিশান ডুপ্লেক্স ভবন।
স্ত্রী সাজেদার বাবা সাবেক ডিস্ট্রিক্ট কানুনগো ও বড় শ্যালক মোখলেছুর রহমান লিটন ঢালী পরিবারেও আজ অর্থবিত্তের শেষ নেই। ধানমন্ডিতে ভুতের আড্ডা নামে রেস্তোরাঁ রয়েছে তার। গিয়াসের সুনজর যার উপর পড়েছে সবাই হয়েছেন পয়সাওয়ালা।
২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই তিন বছরে লিটন ঢালীর একাউন্ট থেকে তার একাউন্টে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে জানা যায়। লিটন রহমান ঢালীর একাউন্টে যে টাকা গিয়েছে সেই টাকা নারায়ণগঞ্জের একটি ব্যাংক একাউন্ট থেকে গিয়েছে এবং ওই টাকা গিয়াস উদ্দিনের কমিশনের টাকা বলে অভিযোগ রয়েছে।
গিয়াস পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের বাল্যবন্ধু, গণভবনের পিয়ন জাহাঙ্গীর, তৎকালীন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানের আত্মীয়তায় দুহাতে গড়েছেন সম্পদ। এছাড়া, সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান ও মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর, নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাবেক নৌ সচিব বহির্গমণের জন্য প্রদেয় সিডিসি স্পেশাল ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের থেকে অগ্রীম ৫ লাখ টাকা জনপ্রতি হিসেবে ১০০ কোটি টাকা লোপাট করেছিল এ চক্র।
এছাড়াও অভ্যন্তরীণ কোস্টাল, ফিশারিজ ও বিদেশগামী জাহাজের বিভিন্ন গ্রেডে চাকুরীরত মাস্টার, নাবিকদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে লাখ লাখ উপার্জনেরও অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
গিয়াসউদ্দীনের পরিবারের দখলে রয়েছে ব্লাক প্রিমিও ব্রান্ডের প্রাইভেট কার, লেটেস্ট ব্রান্ডের দুটি এক্স করলা, ও দুটি নোয়া মাইক্রো। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের দপ্তরে এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন জনৈক ইফতেখার আহমেদ নামে এক ভুক্তভোগী।
অভিযোগ বিষয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ডিজি কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জরুরি মিটিংয়ে আছেন বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। অভিযোগের বিষয়ে গিয়াস উদ্দিনের সাথে কথা বলতে যোগাযোগ করলেও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।