গতি হারানো প্রকল্প পাতাল মেট্রোরেল
- সময় ১০:৫৬:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫
- / 27
পাঁচ বছর আগে দেশের প্রথম পাতাল (আন্ডারগ্রাউন্ড) মেট্রোরেল প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হলেও এর মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ এখনো শুরুই হয়নি।
ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন-১ (এমআরটি লাইন-১) এর কাজ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকার এই প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এখন পর্যন্ত ১২টি প্যাকেজের মধ্যে মাত্র একটির জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করতে পেরেছে।
এই প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তা পূরণ করা সম্ভব নয়। প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন-চার বছর বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। ফলে ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়তে পারে।
গত মাসে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কর্মকর্তারা জানান, কোভিড-১৯ এর বিধিনিষেধ এবং প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই মূলত এই বিলম্ব হয়েছে। ওই বৈঠক থেকে দরপত্র প্রক্রিয়ায় গতি আনার সিদ্ধান্ত হয়।
এমআরটি লাইন-১ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে কমলাপুর রেলস্টেশনের সঙ্গে যুক্ত করবে। পূর্বাচল এবং নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশও এই মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে।
৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই লাইনের মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে। নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। মোট স্টেশন থাকবে ১৯টি।
এই পথ দিয়ে প্রতিদিন আট লাখ যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবে। বাংলাদেশে পরিবহন খাতে এটাই হবে বৃহত্তম একক প্রকল্প। এতে ঢাকা শহরে যানজট ও দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এর আগের সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১৪০ কিলোমিটারের একটি মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল। এর একটি অংশ হিসেবেই তৈরি হচ্ছে এমআরটি লাইন-১।
গতি হারানো এক প্রকল্প
২০১৯ সালের অক্টোবরে এমআরটি লাইন-১ প্রকল্প অনুমোদনের পর, করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হয়। তখন বিস্তারিত নকশা তৈরিতে বিলম্বের কারণে প্রথম ঠিকাদার নিয়োগ করতে তিন বছর লেগে যায়।
২০২২ সালের অক্টোবরে রূপগঞ্জে পীতলগঞ্জে মেট্রোরেলের ডিপোর জমি উন্নয়নের জন্য জাপান-বাংলাদেশ জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের ভৌত কাজের উদ্বোধন করেন। জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন কোং লিমিটেড এবং বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পরের মাসেই প্যাকেজ-১ এর অধীনে ডিপোর উন্নয়ন কাজ শুরু করে। গত ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজের ৮৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
কিন্তু ডিএমটিসিএল এখনো মাটির নিচে টানেল খনন, ভায়াডাক্ট ও স্টেশন নির্মাণ, ট্র্যাক ও পাওয়ার লাইন স্থাপন এবং ট্রেন কেনার কাজের জন্য কোনো ঠিকাদার নিয়োগ করতে পারেনি।
এখন পর্যন্ত নয়টি প্যাকেজের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে তারা।
প্রকল্পের নথি থেকে জানা যায়, প্যাকেজ-৫ এর অধীনে নাড্ডা স্টেশন থেকে নতুন বাজার স্টেশন (একটি ইন্টারচেঞ্জ) পর্যন্ত পাতাল লাইন এবং দুটি স্টেশন নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে প্রাক-চুক্তি আলোচনা চলছে।
অন্য আটটি প্যাকেজ এখন দরপত্র প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। আরও দুটি প্যাকেজের খসড়া নথি এখন জাইকার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
এদিকে, ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তরের জন্য মেট্রো কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। পাঁচটি স্টেশনের আশপাশ থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির লাইন স্থানান্তরের কাজ শুরু করেছে তারা।
এছাড়া, এখন পর্যন্ত ১১৫ একর জমির মধ্যে ৯৩ একর অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রউফের সভাপতিত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় বরাদ্দকৃত ৩ হাজার ৫৯৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকার মধ্যে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মাত্র ৫২৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা (১৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ) খরচ করতে পেরেছে। প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি মাত্র ৬ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
সভায় প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়ার সকল পর্যায়ের জন্য জাইকার সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক এবং জাইকা প্যাকেজগুলোর অগ্রাধিকার বিবেচনা করে অনুমোদন দেয়। এছাড়া, প্রকল্পটি অনুমোদনের মাত্র ছয় মাস পরেই কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হয়, যার ফলে বিস্তারিত নকশা তৈরি, জমি অধিগ্রহণ এবং অন্যান্য কাজ বিলম্বিত হয়।
সভায় দরপত্র প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি দ্রুত জমি অধিগ্রহণ করার জন্য একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০৩০ সালের আগে নয়?
কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই লাইনে মেট্রোরেল চালু করার যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়।
ভৌত কাজ শুরুর দিন থেকে এমআরটি লাইন-৬ (উত্তরা-মতিঝিল) এর আংশিক কার্যক্রম শুরু করতে ছয় বছরের বেশি সময় লেগেছিল।
ডিএমটিসিএলের একজন কর্মকর্তা দরপত্র নথি দেখে বলেন, চুক্তি স্বাক্ষরের পর ঠিকাদাররা মাটির নিচে লাইন নির্মাণের জন্য পাঁচ বছর এবং উড়াল লাইনের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় পাবেন।
এই হিসাবে, যদি এই মাসেই পাতাল লাইনের প্যাকেজের চুক্তি হয়, তাহলে ঠিকাদাররা ২০৩০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কাজ শেষ করার সময় পাবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, প্যাকেজ-৫ এর চুক্তি সম্ভবত মার্চ মাসে এবং অন্যান্য প্যাকেজের চুক্তি তিন-চার মাস পরে হতে পারে।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে, ২০৩০ সালের আগে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে
গত ৬ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেট্রোরেলের কাজে গতি আসছে। এতে বলা হয়, ডিপোর জন্য ভূমি উন্নয়ন কাজের ৮৭ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে এবং পাতাল লাইন নির্মাণে চারটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, তিনি ও তার সহকর্মীরা ক্রয় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে প্যাকেজ-২ ও ৫ এর চুক্তি সই হওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
মেট্রোরেলের ডিপোর কাঠামো প্যাকেজ-২ এর অধীনে নির্মিত হবে, বলেন তিনি।
কবে নাগাদ সব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি জাইকার সম্মতিসহ অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। তাই সুনির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া কঠিন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যখন প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় তখন মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ছিল প্রায় ৮৫ টাকা, বর্তমানে তা ১২০ টাকার বেশি। এতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে।