দুর্নীতির অভিযোগ, তবুও ঢাকায় চমকপ্রদ পোস্টিং!

- সময় ১১:০০:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫
- / 477
গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম ময়নুল হক; বিগত সরকারের সময় ছিলেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। সেখানকার দুই মন্ত্রীরও আস্থাভাজন ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে তার বিরুদ্ধে প্রায় শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগ তদন্ত না করে উল্টো তাকে চট্টগ্রাম থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ জোনে পোস্টিং করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিজের বিরুদ্ধে ওঠা শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগকে ৫ আগস্টের পর উল্টো হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন এই কর্মকর্তা। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের স্বীকার দাবি করেন। বর্তমানে এই কর্মকর্তা ঢাকায় গণপূর্তের ই/এম বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত আছেন।
গত ১১ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে জমা হওয়া এক অভিযোগে জানা যায়, চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম-১) থাকাকালিন এসএম ময়নুল হক নিজের পকেট ‘ভারি করতে’ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাপানি ব্র্যান্ডের বদলে লাগিয়েছেন চায়না লিফট। তার অধীনে সম্পন্ন হওয়া দরপত্রের সাশ্রয়কৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ভুয়া কাজের বিল ভাউচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। ক্ষমতার দাপটে ‘টু পাইস’ কামিয়ে নিজ জেলা পাবনা সদরে গড়েছেন বিশাল অট্টালিকাও। সরকারি চাকরির পাশাপাশি বিনিয়োগ করেছেন ঠিকাদারি ব্যবসায়ও।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়া সত্ত্বেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আলোচিত বালিশ কাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ঠিকাদার শাহাদত হোসেনের সাজিন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কার্যাদেশ দেন নির্বাহী প্রকৌশলী ময়নুল হক।
শুধু তাই নয়, দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে চাওয়া ঠিকাদারদের সম্ভাব্য ব্যয়ের ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হয় ময়নুল হককে ‘খুশি’ করতে! আর তা না দিলেই ঠিকাদারের দরপত্রটিকে ‘নন রেস্পন্সিভ’ করে দেন তিনি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রশাসনিক ভবনের উর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজের জন্য জার্মানীর বিখ্যাত LM ব্র্যান্ডের ৮০০ কেজি ক্ষমতাসম্পন্ন দুইটি লিফট সরবরাহের নির্দেশ থাকলেও নামসর্বস্ব নকল দুটি চায়না লিফট স্থাপন করে কাজ শেষ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম ময়নুল হক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাহেনা আক্তার লিফটগুলোর বিষয়ে বারবার অভিযোগ করেও কোন সুরহা পাননি।
এছাড়া দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ ওই হাসপাতালের গাইনী অপারেশন থিয়েটার, পশ্চিম অপারেশন থিয়েটার, লেবার রুম, নিউনেটাল বেবি কেয়ার ইউনিট, কার্ডিয়াক সার্জারী ভবনসহ বিভিন্ন অপারেশন থিয়েটারে সেন্ট্রাল ডাক্ট এসি স্থাপন কাজে পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিনসহ সিডিউল স্পেসিফিকেশনের তোয়াক্কা না করে স্থাপন করেছেন স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত এয়ারকুলার (এসি)।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে নিম্নমানের এয়ারকুলার বসানো হলেও, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ময়নুল হক ছিলেন নিশ্চুপ। এছাড়া, নগরের কল্পলোক মডেল মসজিদেও বৈদ্যুতিক কাজ করিয়েছেন নিম্নমানের ক্যাবল দিয়ে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে গত পাঁচ বছরে আসা বরাদ্দে দরপত্র পরবর্তী সাশ্রয় হওয়া অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোও রয়েছে এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, এসএম ময়নুল হকের সাবেক সহকর্মী ও তার বন্ধু মোহাম্মদ সোলাইমান। তার মাধ্যমে ‘শাহনেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ’ এর নামে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র স্থাপন, ডাক্ট এসি স্থাপনের কাজ দেন তিনি। আবার ওই একই লোকের মাধ্যমে ‘গ্রীন মার্কার’ নামক প্রতিষ্ঠানের নামে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল গ্যাস সিস্টেম স্থাপনের কোটি কোটি টাকার কাজ দেন। আর ওই কাজগুলোতে, টেন্ডার স্পেসিফিকেশন ভঙ্গ করে নিম্নমানের ক্যাবল, সার্কিট ব্রেকার, প্যানেল, এসিসহ অন্যান্য মালামাল ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই বন্ধুর সাথে তার নিজেরও বিনিয়োগ রয়েছে।
ঘুষ না দিলে কিংবা নিজের প্রিয় ঠিকাদাররা সর্বনিম্ন দরদাতা না হলে কোনো কারণ ছাড়াই একই প্রাক্কলন দিয়ে তিনি করে দেন রি-টেন্ডার। এমন কয়েকটি দরপত্রের আইডি নং যথাক্রমে- ৮২৫৮৬৭, ৮১৭৭৯৬, ৭৭৯৩৯০, ৭৮৩৪৯৫। এর মধ্যে প্রথম তিনটি দরপত্রে তার পছন্দের ‘চিটাগাং বিল্ডার্স কর্পোরেশন’ সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়ার কারণে ফের দরপত্র আহ্বান করান এসএম ময়নুল হক। পরবর্তীতে ওই ঠিকাদারকে দিয়ে ১০ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা দিতে বলেন তিনি। কিন্তু, সেবারও পূর্বের ঠিকাদার দরপত্র জমা করলে ই-জিপির ম্যাট্রিক্স সিস্টেমের তোয়াক্কা না করেই ‘নন-রেসপন্সিভ’ করে দেন প্রকৌশলী ময়নুল।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে সব কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও চাহিদামতো ঘুষ না দিলে দরদাতা ঠিকাদারদের ‘নন-রেসপন্সিভ’ করে দেন এসএম ময়নুল হক। আর ঘুষ না দেওয়ায় অনেক কাজ পায়নি দেশের স্বনামধন্য সব ঠিকাদাররা।