ঢাকা ০৬:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কখন থেকে ছাত্রলীগ কলঙ্কিত হলো ?

আকাশ ইসলাম
  • সময় ০১:৩২:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
  • / 243

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ পরবর্তী রাজনীতির বাঁকে বাঁকে রয়েছে সংগঠনটির গৌরবময় ইতিহাস। গেল সপ্তাহে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটি।

স্বাধীনতার আগে এটি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিল। তখন থেকেই সংগঠনটিকে সাধারণত ছাত্রলীগ নামে ডাকা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।

ছাত্রলীগ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপরে ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এগারো দফা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, দীর্ঘ সামরিক শাসনের সময় ছাত্রলীগ কিছুটা নিষ্ক্রিয় হলেও, ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ফের সংগঠিত হয়। স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু ৯০ দশকের শেষের দিকে এসে ছাত্রলীগের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়, যেখানে তাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতা-দখল এবং দলীয় কোন্দল ছাত্রলীগের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং সহিংসতার অভিযোগ ওঠে।

বিশেষ করে, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল ব্যাপক সমালোচিত। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের অভিযোগে ছাত্রলীগের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এরপর বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, ভিন্নমত দমনে সহিংসতা এবং নিয়োগ বাণিজ্যের মতো ইস্যুতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে।

এভাবে ধীরে ধীরে ছাত্রলীগ তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল উদ্দেশ্য ও গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকে। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ছাত্রলীগকে একটি বিতর্কিত সংগঠনে পরিণত করেছে। গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কার্যক্রম মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার এবং ক্ষমতা ধরে রাখার দিকে মনোযোগী বলে মনে করা হয়।

বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত এবং ১,৫০০ জন গুরুতর আহত হয়। আবার ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২৯ জনে, শুধু ২০১৮ সালেই ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার পর “বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করার” দাবি উঠে। এরপর ২০২২ সালের ২৬ মে, ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর ধারাবাহিক হামলার পর, আটটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দেয়।

সবশেষ জুলাই গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৩ অক্টোবর, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর অধীনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

শেয়ার করুন

কখন থেকে ছাত্রলীগ কলঙ্কিত হলো ?

সময় ০১:৩২:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ পরবর্তী রাজনীতির বাঁকে বাঁকে রয়েছে সংগঠনটির গৌরবময় ইতিহাস। গেল সপ্তাহে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনটি।

স্বাধীনতার আগে এটি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিল। তখন থেকেই সংগঠনটিকে সাধারণত ছাত্রলীগ নামে ডাকা হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।

ছাত্রলীগ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপরে ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এগারো দফা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, দীর্ঘ সামরিক শাসনের সময় ছাত্রলীগ কিছুটা নিষ্ক্রিয় হলেও, ১৯৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ফের সংগঠিত হয়। স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু ৯০ দশকের শেষের দিকে এসে ছাত্রলীগের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়, যেখানে তাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার অভিযোগ ওঠে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতা-দখল এবং দলীয় কোন্দল ছাত্রলীগের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং সহিংসতার অভিযোগ ওঠে।

বিশেষ করে, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল ব্যাপক সমালোচিত। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের অভিযোগে ছাত্রলীগের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

এরপর বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়রানি, ভিন্নমত দমনে সহিংসতা এবং নিয়োগ বাণিজ্যের মতো ইস্যুতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে।

এভাবে ধীরে ধীরে ছাত্রলীগ তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল উদ্দেশ্য ও গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকে। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা ছাত্রলীগকে একটি বিতর্কিত সংগঠনে পরিণত করেছে। গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কার্যক্রম মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার এবং ক্ষমতা ধরে রাখার দিকে মনোযোগী বলে মনে করা হয়।

বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত এবং ১,৫০০ জন গুরুতর আহত হয়। আবার ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২৯ জনে, শুধু ২০১৮ সালেই ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার পর “বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করার” দাবি উঠে। এরপর ২০২২ সালের ২৬ মে, ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর ধারাবাহিক হামলার পর, আটটি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দেয়।

সবশেষ জুলাই গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৩ অক্টোবর, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর অধীনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।