ইসলামে ওয়াকফ কতটা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত

- সময় ১১:৫১:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ এপ্রিল ২০২৫
- / 36
ইসলামে ওয়াকফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও দানমূলক কর্ম। এটি মূলত মুসলমানদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষ করে যাঁদের সামর্থ্য ছিল, তাঁরা প্রায় সবাই ওয়াকফ করেছেন।
ওয়াকফের সংজ্ঞা
‘ওয়াকফ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো—আটকে রাখা, স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করা। আর ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ হলো—কোনো জিনিসের মূল মালিকানা রেখে এর উপকার ও সুবিধা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার উপযোগী করে দেওয়া।
ভারতের ১৯১৩ সালের মুসলিম ওয়াকফ আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ হলো—একজন মুসলমান তার সম্পত্তির কোনো অংশ এমন কাজে স্থায়ীভাবে দান করেন, যা ইসলামে ‘ধর্মীয়, পবিত্র বা সেবামূলক’ হিসেবে স্বীকৃত।
ওয়াকফের শরিয়তসম্মত প্রমাণ
ওয়াকফ একটি সুন্নাহভিত্তিক আমল, যা রসুল (সা.)-এর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সাহাবিদের মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) খায়বারে একটি ফলপ্রসূ জমি লাভ করেন। তিনি রসুল (সা.)-এর কাছে এসে পরামর্শ চাইলেন। রাসুল (সা.) বললেন, “তুমি চাইলে এর মূল স্বত্ব স্থায়ীভাবে রেখে, এর উৎপন্ন ফসল সদকা করতে পারো।” এরপর ওমর (রা.) এই জমি অভাবগ্রস্ত, আত্মীয়, দাসমুক্তি, মুসাফির ও মেহমানদের কল্যাণে সদকা করেন এবং শর্ত দেন—এটি বিক্রি, দান বা উত্তরাধিকার হিসেবে দেওয়া যাবে না (বুখারি: ২৫৮৬)।
ওয়াকফের প্রকারভেদ
ওয়াকফ সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে, ১. ওয়াকফ ফি সাবিলিল্লাহ – শুধুমাত্র ধর্মীয় বা জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে ওয়াকফ। ২. ওয়াকফ আলাল আওলাদ – নিজের সন্তান-পরিবারের কল্যাণে ওয়াকফ। ৩. মিশ্র ওয়াকফ – ধর্মীয় ও পারিবারিক দুই উদ্দেশ্যেই সম্পদ ওয়াকফ করা।
কোন কোন জিনিস ওয়াকফ করা যায়
স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে যেমন—জমি, ঘরবাড়ি এবং অস্থাবর সম্পদের মধ্যে যেমন—বই, অস্ত্র, কাপড় প্রভৃতি ওয়াকফ করা যায়। যেমন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) তার বর্মসহ কিছু সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করেছিলেন (বুখারি: ১৩৯৯)। আলেমদের মতে, মসজিদে মাদুর, মোমবাতি, এমনকি অলঙ্কারও ওয়াকফযোগ্য, যদি সেগুলো উপকারী হয়।
ওয়াকফ করার শর্তাবলি
ওয়াকফকারী ও ওয়াকফকৃত বস্তুর জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত মানা জরুরি: ওয়াকফকারীর শর্ত: সে দান করার অধিকার রাখে (মালিক হতে হবে) প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান ও বুদ্ধিমান হতে হবে সম্পত্তির মালিকানায় কোনো অনিশ্চয়তা থাকতে পারবে না ওয়াকফকৃত বস্তুর শর্ত: বস্তুটি মূল্যবান ও উপকারে আসে। নির্দিষ্ট ও পরিমাণযোগ্য হতে হবে। সম্পূর্ণভাবে ওয়াকফকারীর মালিকানাধীন হতে হবে। বস্তুর উপকার বৈধ এবং সমাজে প্রচলিতভাবে ব্যবহারযোগ্য হতে হবে।
ওয়াকফ থেকে উপকার পাওয়ার পদ্ধতি
ওয়াকফকৃত সম্পদ থেকে উপকার নেওয়া যায় বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে, যানবাহনে চলাচল করে, কিংবা পশুর দুধ, পশম বা ডিম সংগ্রহের মাধ্যমে। এসব পদ্ধতিতে ওয়াকফের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয়।
ওয়াকফ ও অসিয়তের পার্থক্য
ওয়াকফ ও অসিয়তের মাঝে মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে: ওয়াকফ জীবিত অবস্থায় কার্যকর হয়, এবং তা প্রত্যাহারযোগ্য নয়। অসিয়ত মৃত্যুর পর কার্যকর হয় এবং তা জীবিত অবস্থায় পরিবর্তন করা যায়। ওয়াকফের মালিকানা দানকারীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না; বরং উপকারভোগীরা কেবল ব্যবহার করতে পারে।
অসিয়তের মালিকানা সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত ব্যক্তির হাতে চলে যায়। ওয়াকফের জন্য কোনো সীমা নির্ধারিত নেই, কিন্তু অসিয়ত শুধুমাত্র মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত করা যায়, ওয়ারিশদের অনুমতি ছাড়া।
ওয়াকফ একটি চিরস্থায়ী সদকাহ, যা ইসলামি সমাজের উন্নয়ন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং সমাজসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শুধুমাত্র আখিরাতে সওয়াবের মাধ্যম নয়, বরং দুনিয়াতেও দরিদ্র ও অসহায়দের সহায়তার একটি কার্যকর উপায়।