ইয়াহিয়া সিনওয়ার: যে নেতা প্রতিরোধকে দিয়েছে নতুন সংজ্ঞা
- সময় ১১:৪৯:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪
- / 228
ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজায় ইহুদিবাদী দখলদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে প্রাণ হারায়। তার হত্যা স্পষ্ট ইঙ্গিত যে সিনওয়ার হামাসের সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকার পরিবর্তে যুদ্ধ করেছিলেন, এবং তাঁর যুদ্ধ সামরিক বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে এগিয়ে থাকা ইসরায়েলের কথিত শ্রেষ্ঠত্বের বিপক্ষে সন্দেহের প্রকাশ।
৬২ বছর বয়সের ইয়াহিয়া ইব্রাহিম হাসান আল-সিনওয়ার যিনি আবু ইব্রাহিম নামেও পরিচিত। ১৯৬২ সালে গাজায় জন্মগ্রহণ করেন সিনওয়ার, যখন গাজা দমন-পীড়ন, কারফিউ, গ্রেপ্তার ও তল্লাশিসহ ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিত্বে বেষ্টিত ছিল। কৈশোর থেকেই সিনওয়ার নিজ ভূখণ্ডের নিপীড়িত মানুষের সাথে গভীর এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরেন।
১৯৭২ সালে যখন তাঁর বয়স মাত্র ১১ বছর, তখন ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে সামরিকভাবে ইসরায়েলকে মোকাবেলা করার নতুন আরব প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন। পরবর্তীতে বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে যার বর্ননা করেছিলেন, আমরা দেখেছি বিজয়ের আশা ভেঙ্গে পড়েছে, বিশেষ করে যখন মিশরের নেতা আনোয়ার সাদাত শান্তির জন্য ইসরায়েলি পার্লামেন্টে গিয়েছিলেন, যাকে আমি স্বাধীন ফিলিস্তিন চিন্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখি।
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজায় প্রথম ইন্তিফাদা বা সংগ্রাম শুরু হয়, যা ছিল ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রথম জনপ্রিয় বিদ্রোহ এবং দ্রুত পশ্চিম তীরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ঘটনার সূত্রপাত ইসরায়েলি সামরিক গাড়ির আঘাতে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে। পরে জানা যায় তা ছিল ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ইচ্ছাকৃত হত্যা। তারপর রাস্তায় নেমে পরে ফিলিস্তিনিরা যাদের অধিকাংশই ছিল তরুণ। পরের দিন প্রভাবশালী নেতা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য শেখ আহমেদ ইয়াসিন গাজার আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে তার সহযোগীদের জড়ো করেন।
দীর্ঘ আলাপ শেষে ইসরাইলকে নির্মূল করার লক্ষ্যে পিএলওর বিকল্প হিসেবে হামাস প্রতিষ্ঠা করার ঘোষনা দেওয়া হয়। একই দিনে সেখান থেকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রকে ‘ইহুদি নাৎসিবাদ’ বলে অভিযুক্ত করে এবং হামাসের প্রতিষ্ঠা সনদের খসড়াও তৈরি করে।
সিনওয়ার ছিলেন হামাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ইসরাইলে হামলার জন্য দায়ী প্রধান ব্যক্তি হিসাবে সিনওয়ারের দিকে নজর ছিল ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার। প্রতিশোধ নিতে তাঁকে হত্যার ছক আঁকে গোয়েন্দারা।
২০০৪ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে সিনওয়ার তার আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পরামর্শদাতা আখ্যায়িত করেন। সূচনা থেকেই হামাস জিহাদে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটি সংগ্রামকে গুরুত্ব দিয়েছে, যা আধ্যাত্মিক এবং সামরিক উভয়ই।
৪টি যাবজ্জীবন সাজা নিয়ে ২২ বছরের ( ১৯৮৮ – ২০১১ ) বন্দী জীবনকে মুক্তির সংগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখেছেন সিনওয়ার। জেল জীবন সিনওয়ারের প্রভাব ও পরিচালনার ক্ষমতাকে প্রবল করেছে, যাকে তিনি শত্রুর ভাষা, মনোবিজ্ঞান এবং ইতিহাস শেখার বিদ্যাপীঠ বিবেচনা করেছেন। অন্য অনেক ফিলিস্তিনি বন্দীর মতো, ইয়াহিয়া সিনওয়ার ইসরায়েলি কারাগারে সময়ের সদ্ব্যবহার করে হিব্রু ভাষা শিখে ইসরায়েলি সংবাদপত্র পড়তেন, হিব্রু রেডিও শুনতেন এবং জায়নবাদী তত্ত্ব ও ইসরায়েলি রাজনীতিবিদদের বই পড়তেন।
বন্দী জীবন সত্ত্বেও, সিনওয়ার তার মুক্তির দিনটির জন্য ক্রমাগত প্রস্তুতি নিয়েছেন শক্তিশালী প্রতিরোধের আশায়। তাঁর দৃঢ়তাই তাঁকে একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে ।
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মুখেমার আবু সাদা এক লেখায় বলেন, ফিলিস্তিনি বন্দীদের জন্য জেল শুধু শাস্তির জায়গা নয় বরং ইসরায়েলি সমাজকে আরও ভালোভাবে বোঝার এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ সংহতি জোরদার করার একটি সুযোগ।
ফিলিস্তিনি এক গণমাধমের সাথে আলাপে সিনওয়ার বলেছিলেন, কারাগার আপনাকে যোদ্ধার আকার দেয়, বিশেষ করে যদি আপনি ফিলিস্তিনি হন, কারণ সেখানে অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের সাথে আপনার কথা হয় এবং সামগ্রিক চিন্তার সংক্রমনও ঘটে।
মুক্তির পর সিনওয়ার অতি দ্রুত গাজায় হামাসের নেতৃত্ব গ্রহণ করে মোহাম্মদ দেইফকে সাথে নিয়ে গত ৫০ বছরের মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বিধ্বংসী অপারেশন ‘আল-আকসা ফ্লাড’ পরিচালনা করেন।
৭ অক্টোবর ২০২৩ ইসরায়েলে হামাস হামলা চালায়। হামলার সেনা সদস্য, বিদেশি নাগরিকসহ মোট এক হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়েছিল বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। পরে তা সংশোধন করে নিহতের সংখ্যা করা হয়েছে এক হাজার ২০০ জন।
অন্যদিকে , গত বছরের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় ৪২ হাজার ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৯৭ হাজার ৭২০ জন যা বিশ্ব রাজনীতিকে নাড়া দিয়েছে। এরপর থেকে সিনওয়ার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চূরান্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
একটি টেলিভিশনে সিনওয়ার ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা স্বীকার করে বলেছিলেন তারা চিরকাল সামরিক সুবিধার উপর নির্ভর করতে পারবেনা। ২০ বছরের মধ্যে ইসরায়েল দুর্বল হয়ে পরবে এবং এখনই আক্রমনের সময়। নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি স্বার্থকে অস্বীকার করে একই সাথে দাবিয়ে রাখার তীব্র প্রচেষ্টায় মধ্যেই থাকে। তাই এখনকার প্রেক্ষাপটে থেকে ‘জিহাদ ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইসরায়েলকে নির্মূল করার’ বিকল্প কিছু নেই।
৭ অক্টোবর আক্রমণ সিনওয়ার সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করেছিল তখন ইসরায়েলের প্রধান শরৎ উদযাপনের শেষ দিনগুলি। শুরুর দিকে হামাসের আক্রমনের প্রভাব এতটাই বিধ্বংসী ছিল যা ইসরায়েলের সম্ভাব্য পতনের আশঙ্কা তৈরি করেছিল।
ইসরায়েলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে কোনো ঘটনাই হামাসের হামলার মতো গভীরভাবে তাদের নিরাপত্তা ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের বোধকে ক্ষুন্ন করেনি।
হামাস ফিলিস্তিনি ঔপনিবেশিক বিরোধী সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব অব্যাহত রাখবে। প্রকৃতপক্ষে, সিনওয়ারের মৃত্যু ইসরায়েলকে কোনোভাবেই নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে না উল্টো ইসরায়েলের ভয়কে আরও তীব্র করে।
সিনওয়ার, হানিয়াহ বা নাসরাল্লাহর মতো নেতা যাদের হত্যা করা হয়েছে, দখলদ্বার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে সংক্রামনের মত নব প্রজন্মের ঔপনিবেশিক বিরোধী নেতার জন্ম নেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র ।