ঢাকা ০২:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতিহাসের খলনায়ক! খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

নিউজ ডেস্ক
  • সময় ০১:২২:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ অগাস্ট ২০২৪
  • / 249

বাংলাদেশ, রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া একটি স্বাধীন জাতি, আর সেই জাতির ইতিহাসে জড়িয়ে থাকা এক বিতর্কিত চরিত্র – খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যিনি, একজন রাজনীতিবিদ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯১৮ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার বর্তমানে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার দশপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন

ব্যক্তি মোশতাকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিলো বর্ণাঢ্য। ১৯৪২ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়; তখন তিনি হন এর যুগ্ম মহাসচিব।

যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৩ সালের আর্টিকেল ৯২- ব্যবহার করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিলে ১৯৫৪ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি কারামুক্ত হয়ে আবার সংসদে যুক্তফ্রন্টের চিফ হুইপ হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করার পর তিনি আবারও বন্দি হন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফার সমর্থন করায় তাকে আবার কারাবরণ করতে হয়। দেশের আটটি রাজনৈতিক দল ১৯৬৯ সালে আইয়ূব বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলে তাতে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পশ্চিম পাকিস্তান অংশের সমন্বায়ক ছিলেন।

১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ূব খানের ডাকা গোল টেবিল বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার কিছু কাজ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়, মোশতাক আহমেদ তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মোশতাক আহমেদের সম্পর্ক ছিল উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মোশতাক আহমেদ বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বাকশালের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু আড়ালে আড়ালে গোপন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল দিন, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর, খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।

মাত্র ৮৩ দিনের শাসনামলে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের জাতির সূর্যসন্তান বলে আখ্যা দেন। তিনি ইনডেমনিটি বিল পাশ করেন। তিনি “জয় বাংলা”স্লোগান পরিবর্তন করে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” স্লোগান চালু করেন।

তার শাসনামলে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মোঃ মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে মিরজাফরের সাথে তুলনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে তার ভূমিকা, ক্ষমতা দখলের পেছনে ষড়যন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া – সবই তাকে দেশের ইতিহাসে একটি নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মোশতাক আহমেদের শাসনামল ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে পালটা অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এবং ছয়-ই নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দী করা হয়।

১৯৭৬ সালে মোশতাক আহমেদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামক এক নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় এবং আদালত তাকে ৫ বছরের শাস্তি প্রদান করেন। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি আবার সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ তিনি মারা যান।

শেয়ার করুন

ইতিহাসের খলনায়ক! খন্দকার মোশতাক আহমেদ।

সময় ০১:২২:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ অগাস্ট ২০২৪

বাংলাদেশ, রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া একটি স্বাধীন জাতি, আর সেই জাতির ইতিহাসে জড়িয়ে থাকা এক বিতর্কিত চরিত্র – খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যিনি, একজন রাজনীতিবিদ, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯১৮ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার বর্তমানে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার দশপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন

ব্যক্তি মোশতাকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিলো বর্ণাঢ্য। ১৯৪২ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়; তখন তিনি হন এর যুগ্ম মহাসচিব।

যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৫৩ সালের আর্টিকেল ৯২- ব্যবহার করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিলে ১৯৫৪ সালে তাকে কারাবরণ করতে হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি কারামুক্ত হয়ে আবার সংসদে যুক্তফ্রন্টের চিফ হুইপ হিসেবে নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করার পর তিনি আবারও বন্দি হন। ১৯৬৬ সালে ছয়দফার সমর্থন করায় তাকে আবার কারাবরণ করতে হয়। দেশের আটটি রাজনৈতিক দল ১৯৬৯ সালে আইয়ূব বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলে তাতে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পশ্চিম পাকিস্তান অংশের সমন্বায়ক ছিলেন।

১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ূব খানের ডাকা গোল টেবিল বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার কিছু কাজ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়, মোশতাক আহমেদ তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মোশতাক আহমেদের সম্পর্ক ছিল উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মোশতাক আহমেদ বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বাকশালের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু আড়ালে আড়ালে গোপন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল দিন, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর, খন্দকার মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।

মাত্র ৮৩ দিনের শাসনামলে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের জাতির সূর্যসন্তান বলে আখ্যা দেন। তিনি ইনডেমনিটি বিল পাশ করেন। তিনি “জয় বাংলা”স্লোগান পরিবর্তন করে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” স্লোগান চালু করেন।

তার শাসনামলে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মোঃ মনসুর আলী ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে মিরজাফরের সাথে তুলনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে তার ভূমিকা, ক্ষমতা দখলের পেছনে ষড়যন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া – সবই তাকে দেশের ইতিহাসে একটি নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মোশতাক আহমেদের শাসনামল ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে পালটা অভ্যুত্থানে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এবং ছয়-ই নভেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দী করা হয়।

১৯৭৬ সালে মোশতাক আহমেদ ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামক এক নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় এবং আদালত তাকে ৫ বছরের শাস্তি প্রদান করেন। জেল থেকে মুক্তির পর তিনি আবার সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ তিনি মারা যান।