সিরিয়াকে নিয়েই খেলছে চার দেশ

- সময় ০৩:৪৩:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৪ মার্চ ২০২৫
- / 58
ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সিরিয়া। বর্তমানে এটি বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তপ্ত কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সিরিয়ায় চলমান সংঘাত ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার নতুন ইসলামপন্থি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক, যা ইসরায়েলের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর্জি জানাচ্ছে, যেন সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখা হয়। ইসরায়েলের আশঙ্কা, তুরস্কের প্রভাব বাড়লে সিরিয়ায় ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোর শক্তি বাড়বে। সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি এবং এই সংকটের পেছনে কী ঘটছে— এসব নিয়েই এ প্রতিবেদন।
তুরস্কের প্রভাব বাড়ছে
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর দেশটির নতুন ইসলামপন্থি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। ২০২৪ সালে বাহার আল-আসাদকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে এ সরকার। তুরস্কের এই ভূমিকা ইসরায়েলের জন্য একটি বড় হুমকি। কারণ তারা মনে করে, তুরস্ক এই সরকারকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করতে পারে। ফলে, মধ্যপ্রাচ্যে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। নতুন ইসলামপন্থি সরকারও ইসরায়েলকে সরাসরি লক্ষ্য করে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছে। এতে ইসরায়েল আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
আতঙ্কে ইসরায়েল
ইসরায়েল মনে করে, সিরিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় সেখানে ইসলামপন্থি শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আস্তানা হয়ে উঠবে। ফলে ইসরায়েলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে, ইসরায়েল আশঙ্কা করছে, সিরিয়ার নতুন সরকার ইসলামিক মৌলবাদী চিন্তা-ধারায় বিশ্বাসী হতে পারে। ইসরায়েল মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ যেমন ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুড, সিরিয়ার ইসলামিক শাসনকে সমর্থন দিতে পারে।
রাশিয়ার উপস্থিতি
সিরিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতি দেশটিকে দুর্বল রাখতে সাহায্য করবে। এতে তুরস্কের শক্তির বিস্তার ঠেকানো যাবে। সিরিয়ায় রাশিয়ার দুটি প্রধান সামরিক ঘাটি—তারতুস ও লাতাকিয়া—ইসরায়েলের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা চায়, এই বাহিনী সিরিয়ায় থাকুক, যেন তুরস্ক অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে। রাশিয়া সিরিয়ায় যে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছে, তা কেবল সিরিয়ার নিরাপত্তা নয়, বরং ইসরায়েলের স্বার্থেও সহায়ক বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের মতে, তুরস্কের তুলনায় রাশিয়া সিরিয়ায় আরও বড় শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। রাশিয়া এখন সিরিয়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করে সেখানে একটি শক্তিশালী প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে। এতে ইসরায়েল নিরাপদ বোধ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানায় ইসরায়েল। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার পক্ষে যুক্তি দেয় দেশটি। তারা একটি গোপন হোয়াইট পেপার’ তৈরি করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে পাঠানো হয়। ইসরায়েল জানিয়েছে, সিরিয়ায় রাশিয়ার উপস্থিতিতে তাদের অঞ্চলে ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। তবে বাইডেন প্রশাসন এই বিষয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, অবশ্য বর্তমান সরকার সিরিয়ার সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছে।
মার্কিন সরকারের মনোভাব
বাইডেন প্রশাসন সিরিয়ার নতুন সরকারকে সাহায্য করার জন্য একটি পরিকল্পনা শুরু করেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি সরানোর শর্তে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা ছিল। তবে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর, বিষয়টি অস্পষ্ট হয়ে যায়। ট্রাম্পের প্রশাসন সাধারণত ইসরায়েলের নিরাপত্তা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী, তাই ইসরায়েলের প্রস্তাবের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব থাকতে পারে। বর্তমানে মার্কিন প্রশাসনের নীতি কিছুটা অস্পষ্ট এবং সিরিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবস্থানও নির্ধারণ হয়নি।
শান্তি চায় তুরস্ক
সিরিয়ার নতুন ইসলামপন্থি সরকারকে সমর্থন দেওয়ার ইসরায়েলের অভিযোগ অস্বীকার করেছে তুরস্ক । তুরস্কেরর দাবি, তারা সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং তাদের কর্মকাণ্ড শুধু সিরিয়ার স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য। তুরস্কের এক কর্মকর্তা জানান, তারা রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভকে সিরিয়ায় আমন্ত্রণ জানিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছে। তুরস্ক মনে করে, সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে ইসরায়েলও লাভবান হবে। তুরস্কের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তারা শান্তির কথা ভাবছে এবং সিরিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।
ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ
সিরিয়ার দক্ষিণে সামরিক স্থাপনায় বেশ কয়েকটি আক্রমণ চালিয়েছে ইসরায়েল। হামলার মধ্যে বিমান হামলাও করেছে। তারা দাবি করছে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সেখানকার সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর শক্তি বৃদ্ধি রোধ করা। একইসঙ্গে তাদের সীমান্তের কাছে কোনো বিপদ যেন সৃষ্টি না হয় তা নিশ্চিত করা। ইসরায়েলের বিমান বাহিনী এ লক্ষ্যে নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে এবং তাদের সামরিক শক্তি সিরিয়াতে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। ইসরায়েল জানে, সিরিয়ায় চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর শক্তি বাড়লে, তাদের জন্য এটি বড় ধরনের নিরাপত্তার হুমকি হতে পারে।
সিরিয়ার ঝোঁক
সিরিয়ার নতুন সরকার রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা করছে। যদিও আগে তাদের সম্পর্ক তিক্ত ছিল, বর্তমানে তারা একটি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিয়েছে। সিরিয়া আশা করছে, রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি তাদের স্বার্থের জন্য উপকারী হতে পারে। সিরিয়ার নতুন সরকার বুঝতে পারছে, রাশিয়ার সামরিক সহায়তা তাদের জন্য অপরিহার্য হতে পারে, বিশেষ করে তুরস্ক ও ইসরায়েলকে মোকাবিলা করার জন্য। তারা রাশিয়াকে এখন এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে ভাবছে।
ইসরায়েল-তুরস্কের দ্বন্দ্ব
ইসরায়েল ও তুরস্কের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই জটিল। গাজা যুদ্ধে তাদের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে ওঠে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইসলামিক দেশগুলোর একটি জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যা ইসরায়েলের জন্য আরও উদ্বেগের কারণ। এরদোয়ান ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে তুরস্কের আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সিরিয়ার পরিস্থিতিতে, তুরস্ক ও ইসরায়েল একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ
সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে তুরস্ক, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া প্রত্যেকেই নিজেদের স্বার্থে সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এখনও অস্পষ্ট এবং মার্কিন পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশ, যেমন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও সিরিয়ার সংকটের সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে। তবে সিরিয়া কীভাবে আগামী দিনে এই জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে, তা নির্ধারণ করবে পুরো অঞ্চলের ভবিষ্যৎ।
তথ্যসূত্র: তেহরান টাইমস, টার্কিস মিনিট, অল ইসরায়েল নিউজ, রয়টার্স।