আজহারের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ

- সময় ০১:৩৬:২৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / 100
২০১২ সালের ২২ আগস্ট, বুধবার। রাজধানীর মগবাজার থেকে মুক্তিযুদ্ধকালে রংপুরে আলবদর বাহিনীর যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারকে। আজ আরেক বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি পেয়েছেন এই জামায়াত নেতা। ২২ এপ্রিল শুনানির দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। তবে তার বিরুদ্ধে ছয়টি যুদ্ধাপরাধের মধ্যে একটিতে রয়েছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের সংশ্লিষ্টতা। এই স্লোগান দেয়ার অপরাধে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে অপরহণ করে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
ছয়টি অভিযোগর ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
মুক্তিযুদ্ধকালে রংপুরে আলবদর বাহিনীর যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দেওয়া এবং অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে। এরপর পুনর্বিবেচনার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেন তিনি।
আজ (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এই অনুমতি প্রদান করেন। এর আগে, গতকাল মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) শুনানি শেষে আদালত আজকের দিনটি আদেশের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন।

জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে যে ছয়টি যুদ্ধাপরাধ আনা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে;
অভিযোগ ১: মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অপহরণ ও হত্যা
১৯৭১ সালের ২৪ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে, ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র সংঘের সশস্ত্র সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী ন্যাপ নেতা ও রংপুরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলী ওরফে জররেজ মিয়াসহ ১১ জনকে অপহরণ করে। তাদের রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আটকে রাখা হয় এবং টানা সাতদিন নির্যাতন চালানো হয়।
এরপর, ৩ এপ্রিল অপহৃতদের রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় একমাত্র দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে মন্টু ডাক্তার গুলিবিদ্ধ হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার শরীরে সেই গুলির চিহ্ন বহন করছিলেন।
এই অপরাধের ভিত্তিতে এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ২: লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যা
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের সশস্ত্র সদস্যদের নিয়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ট্রেনে করে রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ট্যাক্সেরহাট রেলগুমটিতে পৌঁছান। সেখান থেকে ধাপপাড়া যাওয়ার পথে আশপাশের কয়েকটি গ্রামে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। এরপর মোকসেদপুর গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৪ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনায় এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৩: গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে, এটিএম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়ুয়ারবিল এলাকার বিভিন্ন গ্রামে হামলা চালায়। এ সময় এক হাজার দুই শতাধিক নিরীহ হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া অন্তত আরও দুই শতাধিক মানুষকে ধরে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে, গ্রামগুলোতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।
এই ঘটনায় এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৪: শিক্ষকদের অপহরণ ও হত্যা
১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল রাত ৯টা থেকে ১২টার মধ্যে, এটিএম আজহারুল ইসলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বদর বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে অভিযান চালান। সেখান থেকে চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনায় এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি হিসেবে এটিএম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং স্থানীয় বিহারিরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের তথ্য সংগ্রহ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহ করত। এর মাধ্যমে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অপহরণ, আটক ও নির্যাতন করা হয়।
এই সময়, রংপুর শহর ও আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মনসুরা খাতুনসহ অসংখ্য নারীকে ধরে এনে রংপুর টাউন হলে আটকে রাখা হয়। সেখানে তাদের ওপর ধর্ষণসহ নানারকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
এই ঘটনায় এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ ৬: ছাত্রলীগ কর্মী অপহরণ ও নির্যাতন
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে, রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার অপরাধে শওকত হোসেন রাঙাকে আটক করে নির্যাতন করেন এটিএম আজহারুল ইসলাম।
এরপর, রাঙার ভাই ও কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগ কর্মী রফিকুল হাসান নান্নুকে রংপুর শহরের বেতপট্টি এলাকা থেকে অপহরণ করে শহীদ মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে তাকে চরম নির্যাতন ও শারীরিকভাবে জখম করা হয়। পরে, নাসিম ওসমান নামে এক অবাঙালির সহায়তায় নান্নুর বড় ভাই সাজ্জাদ জহির তাকে উদ্ধার করেন।
এই ঘটনায় এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
এদিকে, আজ (২৬ ফেব্রুয়ারি) বেলা পৌনে ১১টায় আপিল বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। আজহারের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিকী। তাকে সহযোগিতা করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রিভিউ থেকে আপিল শুনানি করার ঘটনা এটিই প্রথম।
এটিএম আজহারুল ইসলামের আইনজীবী জানান, বিচারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের রীতিনীতি না মানা, ন্যায়ভ্রষ্ট বিচার, মামলায় নানা অঙ্গতিসহ ৪টি কারণে এ আদেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শতশত বাড়ি-ঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো নয় ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের মধ্যে ১ নম্বর বাদে বাকি পাঁচটি অভিযোগে তাকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেন। যদিও এটাকে প্রহসনের রায় বলে আখ্যায়িত করে আসছে জামায়াতে ইসলামী।
২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ১১৩ যুক্তিতে জামায়াত নেতা আজহারকে নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়ে আপিল করেন তার আইনজীবীরা। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় ৯০ পৃষ্ঠার মূল আপিলসহ ২ হাজার ৩৪০ পৃষ্ঠার আপিল দাখিল করা হয়।