মহাপ্রাণ নেতাজী কতটা রহস্যময় ছিলেন!
- সময় ০৮:৪৫:৫৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫
- / 23
ফরোয়ার্ড ব্লক বিশ্বাস না করতে পারে নেতাজী এমিলিকে বিবাহ করেননি। এখনও সেই বিতর্ক তারা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কৃষ্ণা বসু ও তাঁর ‘নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো’-তে রাখা নেতাজীর সহস্তে লেখা চিঠি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। হ্যাঁ, নেতাজী বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের মেয়েই অনিতা বসু। বিবাহের পরে যিনি অনিতা বসু পাফ। সেই চিঠিতে স্ত্রী কন্যার বসু পরিবারে স্বীকৃতি চেয়েছিলেন সুভাষ।
বিতর্কের অন্যতম কারণ হিসাবে অনেকক্ষেত্রেই একটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। কি সেই কারণ? বলা হচ্ছে সুভাষচন্দ্র ১৯৩৯ সালের ২৩ নভেম্বর চীন ভ্রমণের ভিসার আবেদনপত্রে উল্লেখ করেছেন তিনি অবিবাহিত আর স্বহস্তে স্বাক্ষর করেছেন। (পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য মহাফেজখানার নথি – নং ৫২৪/৩৯)।
কিন্তু কৃষ্ণা বসুর লেখা ‘আ ট্রু লাভ স্টোরি-এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’ বইতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে নেতাজী ও এমিলি ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিবাহ করেছিলেন। এই তথ্য তারা অনেক পরে জানতে পারেন। যারা এই তথ্য বিশ্বাস করেন না , বা এই তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তাদের নেতাজীর নিজের হাতের লেখা চিঠি ধন্ধে ফেলতে পারে। চিঠিতে সুভাষ তাঁর ফিরে না আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। স্পষ্ট লিখেছেন তাঁর বিবাহ ও মেয়ের কথা। লিখেছেন যেন তিনি না থাকলে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে যেন গ্রহণ করে তাঁর পরিবার। এই চিঠিই তাঁর লেখা শেষ চিঠি যা তিনি দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসুকে।
কি লেখা আছে সেই চিঠিতে? বার্লিন ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে সুভাষ তাঁর মেজদাদা শরৎচন্দ্র বোসকে লিখেছেন , ‘আজ পুনরায় আমি বিপদের পথে রওনা হইতেছি। এবার কিন্তু ঘরের দিকে। হয় তো পথের শেষ আর দেখিব না। যদি তেমন বিপদ পথের মাঝে উপস্থিত হয় তাহলে ইহজীবনে আর কোনও সংবাদ দিতে পারিব না। তাই আমি আমার সংবাদ এখানে রাখিয়া যাইতেছি। – যথা সময়ে এই সংবাদ তোমার কাছে পৌঁছিবে।’ এরপরেই নিজের স্ত্রী ও মেয়ের কথা উল্লেখ করেছেন নেতাজী।
তিনি লিখেছেন, ‘আমি এখানে বিবাহ করেছি এবং আমার একটি কন্য হইয়াছে। আমার অবর্তমানে আমার সহধর্মিণী ও কন্যার প্রতি একটু স্নেহ দেখাইবে – যেমন সারা জীবন আমার প্রতি করিয়াছ। আমার স্ত্রী ও কন্যা আমার অসমাপ্ত কার্য শেষ করুক – সফল ও পূর্ণ করুক – ইহাই ভগবানের প্রতি আমার শেষ প্রার্থনা।’ চিঠির শেষে লেখা রয়েছে । ‘আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহন করিবে – মা , মেজ বৌদিদি এবং অন্যান্য গুরুজনকে। ইতি তোমার স্নেহের ভ্রাতা সুভাষ।’
এবার বিতর্ক এখানেও থামতে না পারে কারণ এখানে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নাম উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি অনেকেই বলতে পারেন কি প্রমাণ রয়েছে ওই লেখা নেতাজীরই। তবে তো প্রশ্ন উঠতে পারে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো এবং কৃষ্ণা বসুর লেখা বই নিয়ে। প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। তবু বাস্তব তো বাস্তবই হয়।
কৃষ্ণা বসুর সন্তান প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুগত বসুর লেখা ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট-সুভাষ চন্দ্র বসু অ্যান্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার’-এ লিখেছেন, এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষের জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। দুজনের মধ্যে প্রেমপত্র বিনিময় হত। এমিলিকে উদ্ধৃত করে সুগত বসু তার বইতে লিখেছেন, প্রেমের আভাসটা সুভাষ চন্দ্র বসুর দিক থেকেই এসেছিল।
১৯৩৪-এর মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছর দু’য়েক অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লোভাকিয়াতে থাকার সময় সম্পর্কটা আরো মধুর হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধের সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সাহায্য পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপের মধ্যে সুভাষচন্দ্র নিজের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতেন। তারপর চিঠিতে উঠে আসে দু’জনের আবেগঘন কথোপকথন।
সুভাষ চন্দ্র এক চিঠিতেই লিখেছিলেন, ‘আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। হতে পারে, পুরো জীবনটাই হয়তো জেলে কাটাতে হবে, অথবা আমাকে গুলি করা হবে, কিংবা ফাঁসিও হতে পারে। এও সম্ভব যে তুমি হয়তো আমাকে কখনো আর দেখতেই পাবে না, অথবা আমি হয়তো কখনো তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না। কিন্তু ভরসা রেখ, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়ে থাকবে, আমার মনে, আমার স্বপ্নে থাকবে। যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জীবনে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি।’
এই চিঠি দেওয়া-নেওয়ার পালার মাঝেই যেবার এমিলি আর সুভাষের দেখা হয়েছিল, তখনই তারা বিয়ে করেন। ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। দুজনেরই পছন্দের রিসর্ট ছিল ওটা। তবে দুজনেই নিজেদের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই অজানা কথাই লেখা রয়েছে ড. কৃষ্ণা বসুর ‘আ ট্রু লাভ স্টোরি-এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’।
পুরো জীবনটাই রহস্যময় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর। তার অজানা অধ্যায় নিয়ে এখনো চলছে গবেষণা। মতান্তরে ভিন্নতা থাকলেও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক হিসাবে তিনি চিরস্মরণীয়। এটাই ধ্রুব সত্য। আজ ২৩ জানুয়ারি মহাপ্রাণ নেতাজী সুভাষ বসুর জন্মদিন।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা এই নেতার জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ । ভারতের স্বাধীনতা-অর্জন আন্দোলনে তিনি হলেন এক অতি-উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র, যিনি নির্দ্বিধভাবে এই মহাসংগ্রামে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি নেতাজী নামে সমধিক পরিচিত। সুভাষচন্দ্র বসু পরপর দু’বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত, কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা এবং বিরুদ্ধ-মত প্রকাশ করার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
মহাপ্রাণ সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের নীতি ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সে কারণে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের সত্বর ও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে এগারো বার কারারুদ্ধ করে। তার চির-অমর উক্তি— “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তার মতাদর্শের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের দুর্বলতাকে সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন; এমনকি কেউ কেউ তাকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে ভারতে অন্যান্যরা তার ইস্তাহারকে রিয়েলপোলিটিক (নৈতিক বা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি)-এর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তার পথপ্রদর্শক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেছেন।
উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরুসহ অন্যান্য যুবনেতারা তাকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি ও তার জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরউইন চুক্তি বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তাকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
তাঁর মৃত্যু নিয়েও রহস্য এখনো চলমান। গবেষকরা সেই রহস্য ভেদ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জন্মদিনে এই মহান নেতাজিকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন তাঁর ভক্ত অনুসারীরা।