জোর করে পদত্যাগ করানো সেই শিক্ষকের মৃত্যু
- সময় ০৯:৪৪:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
- / 38
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা চট্টগ্রামের হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুব হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। শনিবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তিনি মারা গেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর তাকে বলপ্রয়োগ করে পদত্যাগ করানো হয়েছিল, ওই সময় তিনি সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটে পড়েন। সেদিন থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এরপর থেকেই প্রায়ই বিষণ্ন দেখা গেছে তাকে।
তবে পরিবার, সহকর্মী ও স্বজনদের দাবি, ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার অপমান সহ্য করতে না পেরেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
পরিবার জানায়, আজ সকাল ১০টার দিকে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। এরপর বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে সেখানে স্বজনরা আহাজারি শুরু করেন। তার স্ত্রী ফারজানা ইয়াসমিনকে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘কলেজের ছাত্রদের কারণে তার মৃত্যু হলো।’
জানতে চাইলে হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজের শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক শিক্ষক এনামুল হাসান বলেন, অসুস্থ হওয়ার পর তিনি বেশ কিছুদিন কলেজে অনুপস্থিত ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর শুনেই জানাজায় অংশ নিতে ছুটে যাই। আসরের নামাজের পর চান্দগাঁওয়ের মৌলভি পুকুর পাড় জামে মসজিদের সামনে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
শিক্ষক এসএম আইয়ুবের ভাগিনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী মোহাম্মদ টিপু বলেন, ছাত্ররা তাকে জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে। এটা নিয়ে তিনি টেনশনে ছিলেন। এ ছাড়া আমার মামার কোনো টেনশন ছিল না। রোববার দুপুরে জোহরের নামাজের পর ওনার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ মাইকপাড়া মাস্টার আবু আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইসরাত আহমেদ রিজভী বলেন, ‘তিনি খুব জনপ্রিয় আর সজ্জন একজন শিক্ষক ছিলেন। পটপরিবর্তনের পর শিক্ষার্থীদের একটা অংশ যেটা করেছে, সেটা সত্যিকার অর্থে অন্যায় ছিল। পদত্যাগের পরও তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছিল। এসব নিয়ে তিনি অনেক চাপে ছিলেন। আজ তো কলেজ কর্তৃপক্ষও এসব কথা বলছে। তবে সে সময় এসব থামানো গেলে হয়তো এ ঘটনা ঘটত না। তার এমন মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।’
প্রাক্তন শিক্ষার্থী শাহারিয়ার হাসান অভি বলেন, স্যার ছাত্র হিসেবে আমরা লজ্জিত। ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবনে আপনার এভাবে সমাপ্তি হবে, চিন্তাও করতে পারলাম না। অপমান আর নিতে পারলেন না স্যার। শেষ পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
কলেজ কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এ কলেজে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল একটি পক্ষ। কখনো বৈষম্যবিরোধী, কখনো এলাকার বাসিন্দা হিসেবে দাপট দেখিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে তারা দাবি-দাওয়ার নামে প্রতিষ্ঠান অচল করার চেষ্টা চালায়। বেতন কমানো ও কিছু শিক্ষকের পদত্যাগ দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কলেজের মাসিক বেতন কমানো হয়। কিন্তু এরপরও ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের কক্ষে গিয়ে অরাজকতা শুরু করে। মাইকে ঘোষণা দিয়ে উপাধ্যক্ষকে পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
একপর্যায়ে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে জোর করে উপাধ্যক্ষ এসএম আইয়ুবকে পদত্যাগপত্রে সই করতে বাধ্য করা হয়। এ সময় পেছন থেকে একজন তাকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখান। একপর্যায়ে উপাধ্যক্ষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের হাতে তিন শিক্ষকের নাম-সংবলিত একটি বরখাস্তের আদেশের কপি ধরিয়ে দিয়ে সেটিতেও সই নেওয়া হয়। যে তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করতে বাধ্য করা হয়েছে তারা হলেন- মো. দবির উদ্দিন, মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ও একেএম ইসমাইল।
২৬ সেপ্টেম্বর ওই ঘটনার বিষয়ে জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি পাঠান চয়ন দাশ। তার পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার এক সপ্তাহ আগে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল্লাহ নূরী হাজেরা-তজু কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ চয়ন দাশকে তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তিনি অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কার্যালয়ে আগে থেকেই হাজেরা-তজু কলেজের কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে দেখতে পান। সেখানে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি এবং জামায়াতের একজন নেতাকে (বিদ্যোৎসাহী) সদস্য করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর পাঠানোর জন্য জোরপূর্বক তার কাছ থেকে (চয়ন দাশের) স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এই স্বাক্ষরে তার কোনো মতামত ছিল না বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
সে ঘটনা সহ্য করতে না পেরেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন দাশের।
তিনি বলেন, দুদিন আগেও আইয়ুব স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমি শারীরিকভাবে দুর্বল। আমি আর চাকরি করব না, ছেলেরা (আন্দোলনরত শিক্ষার্থী) বাধ্য করেছিল তখন রিজাইন দেওয়ার জন্য।’ একজন ছেলে মানুষ যদি আপনাকে অপমান করে তাহলে যন্ত্রণা তো থেকেই যাবে। ৩৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন, কিন্তু নিজের ছেলেকে ৩৪ ঘণ্টাও না পড়িয়ে এই সমাজের জন্য কাজ করেছেন। সবটুকু বিলিয়েছেন মানুষের লাভের জন্য। কিন্তু আজ এই জ্ঞানের বাতিঘরের অকাল মৃত্যু হলো।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রাসেল আহমেদকে পুরো বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, আমি নির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে আছি। বের হয়ে কথা বলবো।