কোথায় গিয়ে ঠেকবে ব্যাংক সুদ হার?
- সময় ০৭:৩৯:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
- / 100
দেশের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। তারা ঘোষণার চেয়ে বেশি অনেক বেশি সুদে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে। এজন্য নতুন নতুন আকর্ষণীয় আর্থিক পণ্যের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। স্বল্প সময়ে মিলিয়নিয়র, লাখপতি, কোটিপতি নানা অফার দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ঠ করছে। সরকারি দপ্তরগুলো থেকে আমানত সংগ্রহেরও ব্যাপক চেষ্টা চলছে।
সরকারি ঋণ অব্যাহত থাকায় ব্যাংকিং খাতে টাকার চাহিদা আরও বাড়ছে। এছাড়া সুদের হারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতের সুদের হার দ্রুত গতিতে বাড়ছে। কিছু ব্যাংক আমানতের উপর ১৬-১৮% পর্যন্ত সুদ প্রদান করছে। ফলে মানুষ নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে ঋণের সুদের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সব ধরণের ঋণগ্রহীতার জন্যই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। উচ্চ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে যেয়ে দেশের একটি অংশ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণ ও আমানতের হারের উপর একটি ক্যাপ রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় ২০২০ সালের মাঝামাঝি। সেই মোতাবেক তফসিলি ব্যাংকগুলির দেওয়া ঋণের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের হার ৬.০ শতাংশের মধ্যে রাখতে বাধ্য হয়। এ কারণে ঋণের সুদের হার ছিল এক অঙ্কে। ২০২৩ সালের প্রথম দিকে সরকার ঋণের সুদের হার বিষয়ে একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯% হারের সীমা তুলে নেয়। তারপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অংশ হিসাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দ্বারা নির্ধারিত বেঞ্চমার্ক ঋণের হার পদ্ধতি ঘোষণা করে। সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়ার পর, সুদের হার অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুদের হার সবচেয়ে বেশি। এটা বাংলাদেশের মতো আমাদের উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। সব মিলে এখন বাংলাদেশের সুদের হার আফ্রিকার যুদ্ধবিধস্ত ও অর্থনেতিকভাবে পর্যুদস্ত দেশের কাছাকাছি।
সাধারণভাবে সুদের হার বিভিন্ন উপায়ে অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে তিনটি ক্ষেত্রে: এর মধ্যে সবেচেয়ে খারাপ দিক হলো- এটি ঋণের খরচ বাড়ায়। এ কারণে ঋণগ্রহীতারা/ব্যবসায়ীরা খরচ কমায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। দ্বিতীয়টি হল ব্যবসার জন্য ঋণের খরচ বৃদ্ধি পায়। শেষটা হচ্ছে বিনিয়োগ কমানো। অত্যধিক সুদের হার ঋণ গ্রহণ এবং বিনিয়োগের উপর প্রভাবের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যখন সুদের হার কম হয়, ঋণ নেওয়া সস্তা হয়ে যায়। ব্যবসা এবং ভোক্তাদের ঋণ নেওয়ার এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করার সম্ভাবনা বেশি তৈরি হয়। সুদেরহার কম থাকলে ব্যবসা সম্প্রসারণে বিনিয়োগের জন্য অর্থের জোগান পেতে উৎসাহিত করতে পারে। যেমন নতুন শিল্পের নতুন সরঞ্জাম কেনা, প্রযুক্তি হালনাগাদ করা বা আরও কর্মী নিয়োগ করা। বিপরীতভাবে, উচ্চ সুদের হার অর্থনীতিতে নতুন শিল্প এবং কর্মসংস্থানে বাধা দিতে পারে।
গত এক বছরে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত সুদের হার। এ কারণে কিছু কারখানা খেলাপি হয়ে পড়েছে। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরাও ঋণ নিতে পারছেন না। উচ্চ সুদের হারের কারণে ব্যবসা করার ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে নির্মাণ খাত। যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে গত পাঁচ প্রান্তিকের মধ্যে বাংলাদেশ তার সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক প্রকাশিত ত্রৈমাসিক তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে জিডিপি বেড়েছে ৩.৯১ শতাংশ। এক বছর আগে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে জিডিপি বেড়েছে ৫.৪২ শতাংশ। এটা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক খবর। জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিনে দিনে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সুদের হার বৃদ্ধির কারণে এসএমই খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতি বিশেষ করে ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। নতুন ঋণ নিয়েও ব্যবসা করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এই এসএমই খাতই অর্থনীতির প্রাণ। দেশের ব্যাংকিং খাতে চলমান তারল্য সংকট ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে। প্রায় দুই বছর ধরে চলমান সংকট এখন আরও তীব্র হয়েছে। নতুন ঋণ দেওয়া তো দূরের কথা কিছু ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থায় দেশের সিএসএমই খাত আর্থিক সংকটে রয়েছে। ব্যাংক ঋণের অভাবে এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কার্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।
অন্যদিকে, উচ্চ সুদের হার ব্যাংক আমানতকে প্ররোচিত করে। কিছু ব্যাংক আমানতের উপর ১৬-১৮% পর্যন্ত সুদ প্রদান করে। সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক ঘোষণার চেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে। সরকারকে ঋণ প্রদান অব্যাহত থাকায় ব্যাংকিং খাতে তরল টাকার চাহিদা বাড়ছে। এছাড়াও সুদের হারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতের সুদের হারও বাড়ছে। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো তুলনামূলক বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে। কিছু ব্যাংক আমানতের উপর উচ্চ সুদ প্রদান করছে। ফলে মানুষ নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ছিল ১৬ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।
সাধারণভাবে অর্থ বা ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে সুদের হার বাড়বে, যখন ঋণের চাহিদা হ্রাস পেলে তা হ্রাস পাবে, এটি বিশ্বব্যাপী একটি সর্বস্বীকৃত একটি বিষয়। তাই বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়াতে হবে। এখন ৫০ শতাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক তারল্য সংকটের মধ্যে রয়েছে। তাই বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ানো খুব কঠিন। এ কারণে সহজে সুদ হার কমানোর কোন লক্ষণই নেই। দেশের ব্যাংকের একটি বড় অংশ টাকা সংকটে সেখানে মানুষকে কিভাবে ঋণ দেবে।
মানুষ তাদের নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। এটা একটা ভালো খবর। অন্যদিকে উচ্চ সুদের হারের কারণে ব্যবসা করার ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ব্যবসা পরিচালনা খরচ অত্যধিক বেড়েছে বলে উল্লেখ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সুদের হার সবচেয়ে বেশি। ট্রেডিং ইকোনমিক্স রিপোর্ট অনুসারে, জাপানে সুদের হার ১.৭%, মালয়েশিয়ায় ৫.৬%, থাইল্যান্ডে ৭%, ভারতে ৯.৯১%। অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্থ দেশ শ্রীলঙ্কায় সুদের হার একক অঙ্কে রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের সুদের হার যেভাবে বাড়ছে এক যুগ আগের মতো ২২ থেকে ২৫ শতাংশে যেয়ে ঠেকার আশঙ্কা রয়েছে। আবার বেকারত্ব রয়েছে চরম আকারে। শ্রমিক অসন্তোষে শিল্প প্রায়ই বন্ধ হচ্ছে। আরো রয়েছে রিজার্ভ সংকট। সুদের হার যেভাবে বাড়ছে এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকের সুদের হার কোথায় যাবে বলা মুশকিল!
লেখক: খান এ মামুন
সাংবাদিক