স্মৃতিসৌধ নিয়ে ঐতিহাসিক আক্ষেপ
- সময় ১১:৫৬:৫৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 22
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে যে বধ্যভূমি বা স্মৃতিসৌধ রয়েছে, সেগুলোতে প্রতিদিন শত শত, কোথাও বছরে কয়েক লাখ দর্শনার্থী ভিড় করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেসব জায়গায় ছুটে যান গবেষকরা। স্মৃতিস্তম্ভগুলোর তথ্যের ব্যাপ্তি ও উপস্থাপন, মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য আধুনিকায়নের সব পদ্ধতিই প্রয়োগ করা হয় এসব স্থানে। একইসঙ্গে ইতিহাস উপস্থাপন ও নিজ দেশকে তুলে ধরার অনন্য প্রকাশ হিসেবেই মনে করা হয় এসব স্থানকে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও মুক্তিযুদ্ধের কোনও স্মৃতিস্তম্ভ বা বধ্যভূমিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আগ্রহের বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক আক্ষেপ। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে এসেও বাংলাদেশের বধ্যভূমি ও স্মৃতিসৌধগুলোকে গুরুত্ব না দেয়ার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
শহীদ সন্তান ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, আমাদের দেশের বধ্যভূমিগুলো ও স্মৃতিসৌধগুলোতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের চর্চাও বিভাজিত হয়ে রয়েছে। তারা বলছেন, সেক্ষেত্রে আমাদের রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষালয়, ধর্মালয়, পরিবারসহ প্রতিটি অঙ্গনে যে ভূমিকা পালিত হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। তারা আরও বলছেন, বিদেশের অনেক গবেষক আসলে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই হয়তোবা জানেন না।
বিশ্বব্যাপী যে কয়টি স্মৃতিসৌধ আগ্রহের জায়গায় শীর্ষে রয়েছে, তার মধ্যে একটি কিগালি গণহত্যা স্মৃতিসৌধ— ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডান গণহত্যার স্মরণে স্থাপিত। প্রায় আড়াই লাখ মানুষের দেহাবশেষ সেখানে সমাহিত করা হয়েছে। কিগালি মেমোরিয়াল সেন্টার আন্তর্জাতিক মানের। এটি আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীদের যেমন আগ্রহের জায়গা, একইসঙ্গে গবেষকদের আগ্রহ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েই এটি ডিজাইন করা হয়েছে। অডিওভিজ্যুয়াল এবং জিপিএস ডকুমেন্টেশন, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির সাক্ষ্য রেকর্ড করে বাজানোর মধ্য দিয়ে প্রাণবন্ত করে রাখা হয়েছে এই স্মৃতিসৌধকে। আরুশার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি স্থানীয় গাকাকা আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরা আছে এখানে। কিংবা বেলজিয়ামের মেনিনগেট মেমোরিয়াল— সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধ স্মৃতিসৌধগুলির মধ্যে একটি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক সৈন্য সম্মুখভাগে যাওয়ার পথ হিসেবে এই জায়গাটিকে বেছে নিয়েছিল। এখনও রোজ সন্ধ্যায় এখানে বিহগল বেজে ওঠে, তখন আশেপাশের সব যানবাহন যে যার জায়গায় থেমে যায়। পোাল্যান্ডের আউশভিটস-বারকেনাউ মেমোরিয়াল অ্যান্ড মিউজিয়ামের কথাও উল্লেখযোগ্য, যেখানে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ দর্শনার্থী প্রায় ২০ লাখের উপস্থিতির কথা সর্বজনবিদিত। ১৯৪৭ সালে এটি একটি স্মৃতিসৌধে পরিণত হওয়ার পর থেকে এখানে এত বেশি দর্শনার্থী এসেছে যে, ব্যারাকের কংক্রিটের সিঁড়িগুলো অতিরিক্ত পদচারণার মসৃণ হয়ে ক্ষয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এত গণহত্যা ও দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গণকবর এবং বদ্ধভূমি থাকলেও এসব জায়গায় বিদেশ থেকে দর্শনার্থী আসা দূরে থাক, দেশের মানুষই খোঁজ রাখে না। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের এ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২৮০টি বধ্যভূমির নাম রয়েছে। সেগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হলেও সবগুলো সম্পন্ন হয়নি। যদিও প্রকৃত বধ্যভূমির সংখ্যা আরও বেশি বলে দাবি করে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি। তারা বছরদশেক আগে একটি জরিপ শেষে জানিয়েছিল— সারাদেশে পাঁচ হাজারের মতো বধ্যভূমি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে তারা ৯৪২টি বধ্যভূমি শনাক্ত করতে পেরেছে।
দর্শনার্থী উপযোগী না করতে পারা ও বিদেশি গবেষকের আগ্রহের জায়গায় পরিণত করতে না পারার কারণ জানতে চাইলে সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর বলেন, এই আলাপ করার আগে আলোকপাত করতে চাই— শ্রদ্ধা জানাবার ব্যাপারে নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কতটুকু আন্তরিক। জাতীয় জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে মহৎ কিছু অর্জনের জন্য যে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে যেতে হয়, ত্যাগের সাগর পাড়ি দিতে হয়, সে ব্যাপারে যথাযথ ওয়াকিবহাল না হলে, সচেতন না হলে রাষ্ট্রীয় কোনও ব্যাপারে আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সম্ভব নয়। ত্যাগের ইতিহাস ও এর গভীরতা, এর মাধ্যমে অর্জিত বিষয়বলির গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারলে শ্রদ্ধাবোধ অনুভূত হয় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধরনের নানা অধ্যায় রচিত হয়েছে— তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ের তরুণ প্রজন্মকে যথাযথভাবে আমাদের রাজনৈতিক সংকট ও ইতিহাস, আমাদের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম, জাতীয় অর্জনের মাহাত্ম্য, মাতৃভূমির জন্য নিযুত মানুষের জীবন বিসর্জনের তাৎপর্য সম্পর্কে জানাবার কাজটি প্রায় হয়নি, অথবা বিভাজিতভাবে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের মীমাংসিত ন্যারেটিভ নিয়ে শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম বেড়ে ওঠেনি, বরং পরস্পরবিরোধী ন্যারেটিভ লালন করে বড় হয়েছে। ফলে যাদের আত্মত্যাগে জন্ম লাভ করেছে বাংলাদেশ, তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাবার তাগিদ অনুভব করায় ঘাটতি রয়েছে। ঠিক একইভাবে আমরা বাইরের দেশের গবেষকদেরকে বাংলাদেশের এই সব স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণের প্রতিআগ্রহী করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি।
৫ আগস্টের পরে গণভবনকে জাদুঘরে রূপ দিতে যে ১৯ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে— তার সদস্য লেখক ও গবেষক সহুল আহমেদ মুন্না মনে করেন, বাংলাদেশে কখনোই বধ্যভূমিকে খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবশ্য স্মৃতিসৌধ আছে। যেমন- খুলনার গল্লামারি। কিন্তু, এগুলো বিদেশের গবেষকদের আগ্রহের বিষয় হতে পারে নাই। এর প্রধান কারণ সম্ভবত— এগুলো বাংলাদেশের গবেষকদের কাছেও আগ্রহের বিষয় হতে পারেনি। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের জেনোসাইড নিয়েই আলাপ-আলোচনা বৈশ্বিক জ্ঞানকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আর সেখানে বধ্যভূমি নিয়ে দুয়েকটা সরল আলাপ ছাড়া আর কোনও গবেষণা বাংলাতেও পাওয়া যায় না। ফলে, বিদেশের অনেক গবেষক আসলে এর অস্তিত্ব সম্পর্কেই হয়তো বা জানেন না।