‘কৃষি তথ্য সার্ভিস’
সূক্ষ্ম কারসাজিতে কয়েক কোটি টাকার দূর্নীতি
- সময় ১২:২৯:২০ অপরাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারি ২০২৫
- / 132
সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারসাজি; আর এরই মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস’ নামের এক সরকারি প্রতিষ্ঠানে। অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি কৃষি তথ্য ও প্রযুক্তি গণমাধ্যমের সাহায্যে তৃণমূল পর্যায়ে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে।
এই লোপাটের সাথে সংস্থাটির প্রেস ম্যানেজার জান্নাতুল ফেরদৌসের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। যারা বই না ছাপিয়ে বিল উত্তোলন, ডায়েরি মুদ্রণে অনিয়ম, কম্পিউটার সামগ্রী, কাগজ ও কালি সরবরাহ ও কৃষি ডায়েরি-২০২৪ ছাপানোয় সূক্ষè সূক্ষè কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা অনিয়ম করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি তথ্য সার্ভিসের কোড (৩২১১১২৮) দেখিয়ে প্রকাশনা (কাগজ ও কালি ক্রয়) খাতে এক কোটি ৫০ লাখ; কম্পিউটার সামগ্রী (কোড ৩২৫৫১০১) ১২ লাখ ৫৭ হাজার, ব্যবহার্য সামগ্রী ( কোড ৩২৫৬১০৩) ১০ লাখ, অনান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম (৩২৫৮১০৫) ৩০ লাখ, অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা (৩২৫৮১০৮) ১০ লাখ, আইসিটি ও সফটওয়্যার (৪১১৩৩০১) ১৫ লাখ ২০ হাজার, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি (৪১১২৩০৩) বাবদ ১৫ লাখ টাকাসহ অন্যান্য কোডের মাধ্যমে প্রায় তিন কোটি টাকা পিপিআর-২০০৮-এর তফসিল ধারা অনুযায়ী সরকারি বিধান মতে কোনো প্রকার উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে লোপাট করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে কৌশল ছিল তিন লাখ টাকার মধ্যেই কোটেশনের মাধ্যমে নিজস্ব কোম্পানি/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে বিল তুলে নেওয়া। প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস ভুয়া চাহিদাপত্র তৈরি করে কোটেশনের মাধ্যমে ক্রয় দেখিয়ে মালামাল না কিনেই অধিকাংশ কোডের টাকা তুলে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়া, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অধিকাংশ কোডের টাকা কোনো দরপত্র আহ্বান না করেই কোটেশনে মাধ্যমে তুলে আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে এই সিিিন্ডকেটের বিরুদ্ধে।
গেল অর্থ বছরে কাগজ ও মুদ্রণ সামগ্রী কেনাকাটায়ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতিবছর ১৩ হাজার ১০০টি করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কৃষি ডায়েরি এআইএস থেকে মুদ্রণ করে সরবরাহ করে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩ হাজার ১০০টি কৃষি ডায়েরি; প্রতিটি ২০০ টাকা হারে ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকার প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু পিপিআর-২০০৮- এর তফসিল-২, পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা: ধারা ৯ (২) ক পৃষ্ঠা নম্বর ৬৭০ সরকারি বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কোটেশনের মাধ্যমে ক্রয়ের বিধান রয়েছে।
ডায়েরি মুদ্রণ মালামাল ই-জিপিতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করেই কাগজ ও মুদ্রণ সামগ্রী ছোট ছোট কোটেশন তিন লাখ টাকার ভেতরে (২০২২- ২৩ অর্থবছরের বিল নম্বর ৫০০ থেকে ৫১৭, টোকেন নম্বর ৫২০৬৫ হতে ৫২০৮২ তারিখ: ২০ জুন ২০২৩ সালে ১৮টি কোটেশনের মাধ্যমে (প্রতিটি কোটেশনে ২ লাখ ৯০ হাজার ৮৯০ টাকা ও ২ লাখ ৯০ হাজার ৪০০ টাকা করে)) ৫২ লাখ টাকার মুদ্রণ সামগ্রী নিজস্ব তিনটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাডে দ্বিগুণ দামে সরবরাহ দেখিয়ে ২৬ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে।
এসব ডায়েরি ছাপাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশে কাগজ দেখানো হয়েছে (২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি) ৬১ গ্রাম। দাম ৩ হাজার ৬২ টাকা। অথচ, ডায়েরিগুলোয় কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে (২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি) ৬১ গ্রাম, যার বাজার দর ১৫০০ থেকে ১৫৫০ টাকা। এআইএস কাগজ কিনেছে (২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি) ৬১ গ্রামের; যার বাজারমূল্য ১৫০০ থেকে ১৫৫০ টাকা। কিন্তু বিলে দেখানো হয়েছে (২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি) ৬১ গ্রাম। বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৬২ টাকা।
এআইএসের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, এই দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রধান তথ্য অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু জাফর আল মনসুর ও প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস। এই দুই কর্মকর্তার কারণে সরকারের ২৬ থেকে ২৭ লাখ টাকা গচ্চা গেছে। যদিও প্রধান তথ্য অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবু জাফর আল মনসুরকে ইতিমধ্যে বদলি করা হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২১১১২৮ নম্বর কোডের আওতায় প্রকাশনা (কাগজ ও কালি ক্রয়) খাতে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার মুদ্রণ উপকরণ (কাগজ ও কালি) ই-জিপিতে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে ৩ লাখ টাকার মধ্যে কোটেশনের সরবরাহ দেখিয়ে মালামাল কেনা হয়। কিন্তু সেগুলো গ্রহণ না করে দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে নিজস্ব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাডে বিল করে টাকা উত্তোলন করে ভাগবাটোয়ারা করেছে এই সিন্ডিকেট।
অভিযোগ উঠেছে, প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌসের যোগসাজশে যে সাইজে কাগজ, গ্রাম ও পরিমাণ দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে সরবরাহ করার চুক্তি ছিল সেভাবে সরবরাহ না করে গোপন চুক্তির মাধ্যমে এসবের দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে নগদ ৭০ লাখ টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন সুরজিত ও তার সিন্ডিকেট।
২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর বিল-টোকেন নম্বর ২০৬ ও ৯ নভেম্বর ১৭৪৩০ নম্বর টোকেনে ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৫ টাকায় ২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি ৬১ গ্রামের ৩৫০০ রিম; ২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি ৬১ গ্রামের ১০০ রিম; ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি ৮০ গ্রামের ৮০ রিম; ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি ১০০ গ্রামের ৫০ রিম; ২৩ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইঞ্চি ১২০ গ্রামের ১০ রিম; ২৫ ইঞ্চি বাই ৩৬ ইজি ১০০ গ্রামের আর্টপেপার ৫০০ রিম; ২ পাউন্ড কালির ৫০০ কৌটা; ২ পাউন্ডের ৪ কালারের কালির ৭০ সেটের দ্বিগুণ দাম দেখিয়ে কোটেশন তৈরি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, পারটেক্স ব্র্যান্ডের কাগজ সরবরাহের কথা থাকলেও রিমের বান্ডিলে কম দামি অন্য ব্র্যান্ডের কাগজ সরবরাহ করেছেন প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস। সংস্থার জন্য কেনা কালি নিয়েও দুর্নীতি করেছেন তিনি।
কৃষি ডায়েরি-২০২৪ ছাপানোয় ২২ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি ৬১ গ্রামের কাগজ ব্যবহার করার কথা। কিন্তু তারা ২০ ইঞ্চি বাই ৩০ ইঞ্চি, ৬১ গ্রামের কাগজ দিয়ে ডায়েরি ছাপাচ্ছেন। কাগজের রিমের বান্ডিলের বাইরে পারটেক্স ব্র্যান্ড দেখানো হলেও ভেতরে অন্য কমদামি কাগজ দেওয়া হয়েছে। বাড়তি বিল দেখাতে এসব কারসাজি চলছে। রাতের আঁধারে নতুন প্রেস বিল্ডিংয়ের চারতলায় গোডাউনে এসব কাগজ তুলে রাখা হয়েছে।
এআইএসের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুন মাসে ফল মেলা উপলক্ষে ‘ফল সম্ভার বই’ ছাপানো বাবদ ২৫ নম্বর বিলে ১২৮ পাতার ৮৯০ কপি বইয়ের জন্য ২ লাখ ৪৮ হাজার ০৮৭; ২৬ নম্বর বিলে ২ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৭ টাকা ও ২৭ নম্বর বিলে ২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৭৫ টাকাসহ মোট ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৯ টাকা তুলে নিয়েছেন পরিচালক। ২০২৩ সালের ২ জুলাই এ অর্থ তুলে নেন তিনি।
এআইএসের ওই সূত্রের দাবি, তিনটি বিলই ভুয়া। প্রেস ম্যানেজার জান্নাতুল ফেরদৌস, তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. আবু জাফর আল মনসুর, ক্যাশিয়ার মো. জুয়েল হোসেন এসব বিলের অর্থ তুলে পরিচালকসহ ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।
২০২৩ সালের ২২ জুন ৫৫৯ নম্বর বিলের মাধ্যমে ডিজিটাল পিভিসি স্টিকার প্রিন্ট ও স্ট্র্যাটো তৈরি দেখিয়ে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌস কোন মন্তব্য করতে রাজি নন বলে জানান।