‘রিসেট বাটন’ চেপে আমরা কী মুছতে চাই?
- সময় ০২:৩৩:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪
- / 261
তরুণরা ‘রিসেট বাটন’ চেপেছে বলে একটি সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মন্তব্য করেন। তার কিছু দিন পরেই মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর সরকারি কলেজের ইনকোর্স পরীক্ষার একটি প্রশ্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়—যেখানে গণঅভ্যুত্থান বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়।
প্রশ্নগুলো এ রকম:
১. ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকারী সংগঠনটির নাম কী?
২. ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নাম কী?
৩. ২০২৪-এর ১০ জন শহীদের নাম লিখ।
৪. গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ স্থিতিশীল রাখতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ছাত্র-জনতার ভূমিকা সংক্ষেপে লিখ।
৫. কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে এক দফার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়? আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় আলোচনা করো।
৬. বাংলাদেশের চাকরিতে কোটা বৈষম্যের স্বরূপ এবং জাতীয় ঐক্য গঠনে কোটা ব্যবস্থার প্রস্তাব আলোচনা করো।
দেখা যাচ্ছে পুরো প্রশ্নপত্র সাজানো হয়েছে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান মাথায় রেখে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় যেহেতু প্রচুর গুজব রটানো হয় এবং তথ্যের নামে প্রচুর ভুল ও অপতথ্য ছড়ানো হয়; প্রচুর বানানো বা এডিটেড ছবি, এমনকি তৈরি করা স্ক্রিনশটও ছড়িয়ে দিয়ে বিভ্রান্তির জন্ম দেওয়া হয়—সে কারণে শুরুতে অনেকেই ওই প্রশ্নের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।
প্রশ্নের ধরন দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন এটা নিতান্তই রসিকতা কিংবা কেউ হয়তো খারাপ উদ্দেশ্যে এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু বাংলা ট্রিবিউন এই প্রশ্নের সত্যাসত্য নিয়ে অনুসন্ধান করে এবং গত ৫ অক্টোবর ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরীক্ষার প্রশ্নে নেই মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রশ্নটি আমি কাল রাতে পেয়েছি। পরীক্ষার আগে তো আর দেখিনি। যে শিক্ষক এই প্রশ্ন করেছেন তিনি নতুন শিক্ষক। কয়েক দিন আগে যোগদান করেছেন। তিনি বঞ্চিত গ্রুপের একজন। কাল আমরা কথা বলবো, কীসের ভিত্তিতে এমন প্রশ্ন করলো, কেন করলো।’
তার মানে প্রশ্নটি ফেইক বা বানানো নয়। সত্যিই এ রকম প্রশ্ন করা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, নবীন শিক্ষক কি গুড ফেইথ ও ইনটেনশন থেকে প্রশ্নটি করেছেন, নাকি তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলতে কী বোঝায়— সেটি জানেন না? বাংলাদেশে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে না জানলে তার শিক্ষক হওয়ারই কথা নয়।
এই প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক ওঠার কারণ যে পুরো প্রশ্নজুড়ে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান সেটি নয়, বরং ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ বিষয়ে পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে দেশের জন্মের ইতিহাস পড়ানো হয়। সেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহান ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস রয়েছে। প্রশ্নপত্র হয় বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের প্রেক্ষাপট বদলে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হয়। কেউ কেউ সাম্প্রতিক আন্দোলনকে ‘বিপ্লব’, এমনকি ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ও বলছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে একটি বিরাট ঘটনা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনটি কীভাবে ও কোন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেলো; কীভাবে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলো; আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দেওয়ার পেছনে কারা কারা ইন্ধন দিয়েছেন—এসব নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর মতো অবস্থা এখনও হয়নি। এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তর গবেষণা হবে বলে ধারণা করা যায়।
তবে রিসেট বাটনে চাপ দেওয়ার অর্থ যদি হয় বাংলাদেশের অতীত মুছে ফেলা; রিসেট বাটনে চাপ দেওয়ার অর্থ যদি হয় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের জায়গায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্থলে ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে রিপ্লেস করা—তাহলে সেটি নতুন বিতর্ক ও সংকটের জন্ম দেবে।
২০২৪ সালের আন্দোলনে যেমন দলমত ও বয়স নির্বিশেষে বাংলাদেশের বিপুল মানুষ সমর্থন দিয়েছে, তেমনি ১৯৭১ সালে এই দেশে যে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন; ২ লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন; ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বতন্ত্র জাতি ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের যে লড়াই-সংগ্রাম; আত্মত্যাগের যে ধারাবাহিকতা; ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে মহান সংগ্রাম—সেই ইতিহাস কোনও রিসেট বাটন প্রেস করে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
মানুষের ঘরে ঘরে হাজার হাজার বইতে ১৯৭১ জীবন্ত। বিদেশের লাইব্রেরিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালির ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের আগে যাদের জন্ম, তাদের স্মৃতিতে মুক্তি-সংগ্রামের দিনগুলো জ্বলজ্বলে। আবার ১৯৭২-১৯৭৫ সালের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, অনিয়ম-দুর্নীতি-অনাচারের স্মৃতিও মানুষ ভুলে যায়নি। এসব দিনের ঘটনাপ্রবাহও অসংখ্য বইতে লিপিবদ্ধ আছে। রিসেট বাটন প্রেস করলেই সেই ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
বলাই হয়, অতীতকে বাদ দিয়ে বর্তমান নির্মাণ করা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের যাত্রা শুরু ১৯৪৭ সালে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৯১৭-এ। ২০২৪ সেই ইতিহাসের একটি বিরাট বাঁকবদল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন যে ১৯৭১ বাদ দিয়ে ২০২৪ থেকে এই দেশের ইতিহাস শুরু হবে, সেটি ভুল। বরং আজকের বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে ১৯৭১ সালের ভিত্তির ওপরে।
২.
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘রিসেট বাটন’ চাপার কথাটি হয়তো প্রতীকী অর্থে ইতিবাচক চিন্তা থেকেই বলেছেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে চেয়েছেন। তার মতে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শাসনব্যবস্থায় এমন এক ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে যা দেশকে একটি স্থবিরতার মধ্যে ফেলেছে। ফলে, এই স্থবিরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন। ড. ইউনূসের এই রিসেট বাটন ধারণা থেকে বোঝা যায় যে তিনি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্যই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে একটি মানবিক, ন্যায়বিচারমূলক, দায়িত্বশীল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য সব কিছু নতুন করে শুরু করার কথা বলছেন। অর্থাৎ রিসেট বাটনকে তিনি হয়তো একটি নতুন ধারণা হিসেবে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ফোনের ‘রিসেট’ মূলত ফোনের সফটওয়্যার বা সিস্টেম সেটিংসকে নতুন অবস্থায় ফিরিয়ে আনার একটি প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে ডিভাইসের সমস্ত সেটিংস, ডাটা ও অ্যাপ্লিকেশন মুছে ফেলা হয় এবং ফোনটি কারখানায় যেভাবে সেটআপ করা হয়েছিল, সেভাবে ফিরে যায়। প্রশ্ন হলো, ড. ইউনূস যে রিসেট বাটনের কথা বললেন, তার মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে কী বার্তা দিতে চাইলেন? সব কিছু নতুন করে শুরু করার কথাটি কি তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বললেন? যদি সেটি হয় তাহলে এর সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ কম।
সুতরাং রিসেট বাটন চেপে যদি অতীতের রাষ্ট্রীয় অনিয়ম-অনাচার-দুর্নীতি-লুটপাট মুছে ফেলা যায়, সেটি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য মঙ্গলজনক। রিসেট বাটন চেপে যদি অতীতের লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের নিরসন করা যায়, সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য বিরাট সম্ভাবনাময়। রিসেট বাটন চেপে যদি দেশ থেকে রাজনৈতিক সহিংসতা দূর করে একটি সহনশীল, মানবিক ও যুক্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা যায়, সেটিই কাম্য। কিন্তু রিসেট বাটনে চাপ দিয়ে অতীত মুছে ফেলতে চাইলে বাঙালি জাতির অনেক বিরাট অর্জন মুছে ফেলতে হবে। রিসেট বাটনে চাপ দিলে কি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো মুছে যাবে? সেটি কি দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে? আবার এও ঠিক যে রিসেট বাটন চেপে নদী খননসহ রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায় যে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর পুনরাবৃত্তি ঠেকানো জরুরি। আবার রিসেট বাটন চাপলে যদি অতীত মুছে যায়, তাহলে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিচার হবে কী করে? তথ্য প্রমাণ মুছে গেলে আদালত বিচার করবেন কীসের ভিত্তিতে?
পরিশেষে, রিসেট বাটন নিয়ে জনপরিসরে যে বিভ্রান্তি ও সংশয় তৈরি হয়েছে, সেটির নিরসন হওয়া দরকার। এটি হতে পারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে অথবা তার পক্ষে তার কোনও উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী অথবা তার প্রেস উইং থেকেও এ বিষয়ে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠানো যেতে পারে যে ড. ইউনূস রিসেট বাটন বলতে আসলে কী বুঝিয়েছেন? এর অর্থ কি অতীত মুছে ফেলা? কোনও একটি জাতির জীবন থেকে কি সত্যিই অতীত মুছে ফেলা যায়? সব বই ও লাইব্রেরি পুড়িয়ে ফেললেও জনমানুষের স্মৃতিতে যে ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, সেটি কি মুছে ফেলা যাবে? তাছাড়া অতীতকে বাদ দিয়ে কি সুন্দর ও সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব?
লেখক: সাংবাদিক।