রমজানে বোধহয় ফলমূল খেতে পারবো না
- সময় ০৯:৪০:৩৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
- / 32
নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জে। এ ধারা থেকে বের হতে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি অন্তর্বতী সরকার। ফলের বাজারে আসা ক্রেতাদের দাবি করে বলেছেন, এখন আর আপেল-কমলা খেতে পারব বলে মনে হয় না। এমনকি আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে বোধহয় ফলমূল খেতে পারবেন না। এ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
শুল্ক আরোপের জেরে ফলের বাজারে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। ফল আমদানিতে শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর প্রভাব দেখা দিয়েছে ফলের বাজারে।
গত ১৫ দিনে আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুরসহ প্রায় সব ধরনের বিদেশি ফলের দাম পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই এসব ফল কিনছেন না। এতে বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
ক্রেতারা বলছেন, আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙুরের মতো ফল কিনতে গেলে আগের চেয়ে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি চাইছেন বিক্রেতারা। এতে মাসের হিসাব মেলাতে গিয়ে ফলের খরচে কাটছাঁট করতে হচ্ছে তাদের।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তের ফলে আমদানি করা ফল বন্দর থেকে খালাস করতে আগের তুলনায় কেজিতে ৪৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ হচ্ছে। এতে দামও বাড়াতে হচ্ছে।
দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমে যাওয়ায় পচনশীল পণ্য ফলের মজুত নিয়ে বিপাকে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। বিক্রি না হওয়ার ভয়ে অনেকে আমদানি বন্ধ করে দিচ্ছেন।
তারা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আগামী রমজান মাসে দেশে চাহিদার বিপরীতে ফলের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। মৌসুম না হওয়ায় রমজান মাসে দেশি ফল বাজারে থাকবে না। সেক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় দিলে আমদানি করা ফল চাহিদা পূরণ করতে পারত।
রমজান মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত অতিরিক্ত নতুন শুল্ক বাড়ানো কার্যকর না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। তারা বলছে, এমনটা না হলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর আর্থিক সংকট আরও তীব্র হবে।
গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শুকনা ও টাটকা ফল আমদানির ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করে। আপেল, আঙুর ও তরমুজের মতো ফল ও জুসের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়।
নতুন করে শুল্ক আরোপের ফলে প্রতি কেজি আপেল, কমলা ও মাল্টায় শুল্ক বেড়েছে অন্তত ১৬ টাকা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তা ২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আঙুর ও আনারে বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাদামতলীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফুজি জাতের আপেল প্রতি কার্টন (১৯-২০ কেজি) পাঁচ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল পাঁচ হাজার টাকা।
প্রতি কার্টন (১০ কেজি) আঙুর পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল চার হাজার ৫০০ টাকা। কমলার দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। কমলার কার্টন (২২ কেজি) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল চার হাজার ৫০০ টাকা।
চায়না কমলার কার্টন (৮-৯ কেজি) আগে ছিল তিন হাজার ১০০ টাকা, এখন তা তিন হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কার্টন (১৪-১৫ কেজি) মাল্টা বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৯০০ টাকায়, যা আগে ছিল তিন হাজার ৫০০ টাকা।
আমদানিতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব ইতোমধ্যে খুচরা বাজারে পড়তে শুরু করেছে। রাজধানীর রায় সাহেব বাজার, সদরঘাট ও সূত্রাপুর বাজারে প্রতি কেজি আপেল (ফুজি) বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়, যা চার-পাঁচ দিন আগে ছিল ২৮০ টাকা।
ভারতীয় কমলার কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ২৯০ টাকায়, আগে যা ছিল ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা। মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা কেজি, যা আগে ছিল ২৬০ টাকা। চায়না কমলা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি, যা আগে ছিল ৩২০ টাকা।
কালো আঙুর ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আগে ছিল ৫০০ টাকা। সাদা আঙুরের কেজি ৩৬০ টাকা, যা আগে ছিল ৩২০ টাকা। লাল আঙুর ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৫০০ টাকা কেজি।
রাজধানীর রায় সাহেব বাজারের ফল কিনতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মো. আনোয়ার। তিনি বলেন, নতুন করে দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ফলের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন। আগামী রমজানে অনেক মানুষকে ফল ছাড়াই ইফতার করতে হবে। কারণ তখন দেশি ফলের কোনো মৌসুম নয়।
সদরঘাটে ফল কিনতে আসা রুবেল শেখ নামে এক ক্রেতা বলেন, আগে যে পরিমাণে ফল কিনতে পারতাম, এখন আর তা পারি না। যে অবস্থা হচ্ছে, সামনে আরআপেল-কমলা খেতে পারব বলে মনে হয় না।
সদরঘাটে ২৮ বছর ধরে ফলের ব্যবসা করেন মো. জামাল শেখ। তিনি বলেন, ফলের পাইকারি বাজারে দাম বাড়লে আমাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। তবে দাম বাড়লে আমার জন্যও তো ক্ষতি। কারণ প্রতিবার দাম বাড়লেই বিক্রি কমে যায়।
তিনি বলেন, মানুষ প্রতিদিনের খাবার খেয়ে ও অন্যান্য খরচ দিয়ে যে বাড়তি টাকা থাকে, তা দিয়ে ফল কিনে খায়। এখন সব জিনিসের দাম বেড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এমনিতেই কমে গেছে। তার ওপর ফলের দাম বাড়ায় আমাদের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
তিনি বলেন, গত ১০ থেকে ১৫ দিনে ফলের দাম বেড়েছে। গরিবরা এখন আর বিদেশি ফল খায় না। তারা দেশি ফল খোঁজে। মানুষের কাছে টাকা নেই। এর ওপর সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানো হয়। রোজা এলে আরও বেশি বাড়ায়। রমজানে ফলের দাম আরও বেড়ে যাবে।
পুরান ঢাকায় গত ১০ বছর ধরে ফলের ব্যবসা করেন মো. সুমন হোসেন। তিনি অবশ্য ফলের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। তার ভাষ্য, আমদানিকারকেরা বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ান।
তিনি বলেন, ফলের এত দাম আগে দেখিনি। এখনই এত দাম, সামনে তো রমজান মাস। তখন কী করবে মানুষ? এবার রমজানে সাধারণ মানুষ ফল খেতে পারবে না। মূলত সিন্ডিকেটের কারণে দাম বাড়ে। ফল মজুত রেখে তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। পর্যাপ্ত ফল আছে। আমদানিকারকেরা বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়ান।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গরিব মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা অনেক আগেই শুল্ক কমানোর জন্য রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দিয়েছিলাম, যাতে রমজানে ফলের দামটা কম থাকে। কিন্তু সরকার উল্টো দাম আরও বাড়াল।
তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্তের কারণে অনেক আমদানিকারকই লোকসানে পড়েছেন। এমন অবস্থায় নতুন করে ফল আমদানিতে সাহস পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব রমজানে অবশ্যই পড়বে।
তিনি আরও বলেন, ফলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রিও কমে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত দুই বছর ধরে মানুষ ফল কম কিনছে। একইসঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, আমাদের দেশে ফলের মোট চাহিদার মাত্র ৩৫ শতাংশ উৎপাদন হয়। আর বাকি ফল আমদানি করতে হয়। কিন্তু শুল্ক বাড়ানোর পর আমদানি কমে গেছে। ফল এখন ধনীদের খাবার হয়ে গেছে।
তিনি জানান, খাদ্যপণ্য হওয়ার পরও বিদেশি ফলকে ২০১২ সালে বিলাস পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এ সিদ্ধান্তের পর প্রতিবছর বাজেটে আমদানি ফলের ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়।
তিনি আরও জানান, ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত আমদানি করা সব ধরনের ফলে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি (আমদানি শুল্ক), ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট ছিল।
বাংলাদেশে ডলার সংকটের মধ্যে ২০২২ সালের মে মাসে সব ধরনের বিদেশি ফল আমদানিতে নতুন করে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করে এনবিআর। তাতে সব মিলিয়ে ফল আমদানিতে শুল্ক-কর বেড়ে দাঁড়ায় ১১৩ দশমিক ৮০ শতাংশে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা নতুনআরোপ করা সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সরকার যদি তা না করে, তাহলে আমরা ফল আমদানি করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। শিগগিরই সংবাদ সম্মেলন করে তা জানিয়ে দেওয়া হবে। এর আগে আমরা সব ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনায় বসব। কারণ আমরা আর লোকসান করতে চাচ্ছি না।
এনবিআর জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ফল আমদানি ১০ হাজার টন কমে। চার-পাঁচ বছর আগেও ৩৫টি দেশ থেকে ফল আমদানি করা হতো। এখন ২২টি দেশ থেকে ফল আমদানি করা হলেও সিংহভাগ আসে চীন ও ভারত থেকে। ফল আমদানির তৃতীয় উৎস দেশ আফ্রিকা। এ ছাড়া মিসর, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে বৈচিত্র্যময় ফল।