ঢাকা ০৫:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যেসব বঞ্চণা সইতে হয়েছে বাঙালিদের

নিউজ ডেস্ক
  • সময় ০৩:২৪:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
  • / 248

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানে জন্ম হয়। কিন্তু মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে সেই দেশটি ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, কেন এত দ্রুত ভেঙে পড়েছিল পাকিস্তান?

পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতুপশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটি গাড়ার কারনে; শাসনক্ষমতাও পশ্চিমে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ পাঞ্জাব রাজ্যের হাতে চলে যায়। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। তারপরেও তারা অর্থনীতি, প্রশাসন এবং সামরিকবাহিনীতে ছিল প্রায় অদৃশ্য। প্রথম থেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হতো, তাদের প্রতি বৈষম্য ছিল সর্বত্র।

১৯৫০ থেকে ৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানকে উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৫ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ । অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশের মাথাপিছু আয় ছিল সমান। বরাদ্দ নিয়ে বৈষম্যের কারনে ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

ঐ ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের বিনিয়োগের অভাবে পূর্ব পাকিস্তান অবকাঠামো, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য দেখা দেয়। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা পূর্বে কমে যায়, যেখানে পশ্চিমে তা তিনগুণ বৃদ্ধি পায়।

১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ছিল ৪১০০০ আর পশ্চিমে ছিল ৪৫০০০। কিন্তু দশ বছর পর ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান গ্রাজুয়েট তৈরি হয় ২৮ হাজার, যেখানে পশ্চিমে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ হাজারে।

সেই সাথে, বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা।

একেতো বরাদ্দ অনেক কম দেওয়া হতো, তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রকাশ্যে এবং গোপনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তহবিল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জটিল সব কর ব্যবস্থার আড়ালে নানা খরচ দেখিয়ে এই তহবিল নিয়ে যাওয়া হতো। এক হিসাবে ২৫ বছরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাচার এই টাকার পরিমাণ ছিল ২৬০ কোটি ডলার।

উচ্চশিক্ষা, সরকারি চাকরি এবং সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রবেশ কঠিন ছিল। এমনকি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৬০০০ অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩০০ জন ছিলেন বাঙালি। এ ধরনের অব্যাহত বৈষম্য এবং নিপীড়নের ফলে বাঙালিরা ধীরে ধীরে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও দৃঢ় হয়।

বাঙালিদের এমন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হতো, যেখানে ̧রুত্বপূর্ণ জাতীয় সিদ্ধান্ত হয় না।

বাঙালিদের সংস্কৃতির ওপরও হামলা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে রবীন্দধনাথ ঠাকুরের সাহিত্য কর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করা হয় এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অনেক শব্দ উর্দু

করে প্রকাশ করা হয়। বছরের পর বছর ধরে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক-সংস্কৃতির নির্যাতন বাঙালিদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

পাকিস্তানের  স্বাধীনতার পরের ২৫ বছর সেই প্রভু-সুলভ মনোভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে পদে পদে। সেই সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েছে এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের বন্যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি কতটা অসহায় এবং ভঙ্গুর। ঐ সাইক্লোনের পর কেন্দধীয় সরকারের ভূমিকা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

১৯৭১ সালে, এই বৈষম্যের চরম পরিণতি ঘটে। বাঙালিরা তাদের জাতীয় পরিচয় এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পর, জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। এই লড়াই শুধু সামরিক ছিল না, এটি ছিল বাঙালির জাতীয় চেতনা, মর্যাদা
এবং তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।

শেয়ার করুন

যেসব বঞ্চণা সইতে হয়েছে বাঙালিদের

সময় ০৩:২৪:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তানে জন্ম হয়। কিন্তু মাত্র ২৫ বছরের মধ্যে সেই দেশটি ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো, কেন এত দ্রুত ভেঙে পড়েছিল পাকিস্তান?

পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতুপশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটি গাড়ার কারনে; শাসনক্ষমতাও পশ্চিমে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার ভরকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ পাঞ্জাব রাজ্যের হাতে চলে যায়। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। তারপরেও তারা অর্থনীতি, প্রশাসন এবং সামরিকবাহিনীতে ছিল প্রায় অদৃশ্য। প্রথম থেকেই বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হতো, তাদের প্রতি বৈষম্য ছিল সর্বত্র।

১৯৫০ থেকে ৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানকে উন্নয়ন বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৫ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সেই বরাদ্দ বাড়লেও তা হয়েছিল ৩৬ শতাংশ । অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশের মাথাপিছু আয় ছিল সমান। বরাদ্দ নিয়ে বৈষম্যের কারনে ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

ঐ ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের বিনিয়োগের অভাবে পূর্ব পাকিস্তান অবকাঠামো, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য দেখা দেয়। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা পূর্বে কমে যায়, যেখানে পশ্চিমে তা তিনগুণ বৃদ্ধি পায়।

১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান গ্রাজুয়েটের সংখ্যা ছিল ৪১০০০ আর পশ্চিমে ছিল ৪৫০০০। কিন্তু দশ বছর পর ১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান গ্রাজুয়েট তৈরি হয় ২৮ হাজার, যেখানে পশ্চিমে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ হাজারে।

সেই সাথে, বিনিয়োগে অবহেলার কারণে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কল-কারখানার কাঁচামালের যোগানদাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা।

একেতো বরাদ্দ অনেক কম দেওয়া হতো, তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রকাশ্যে এবং গোপনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে তহবিল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জটিল সব কর ব্যবস্থার আড়ালে নানা খরচ দেখিয়ে এই তহবিল নিয়ে যাওয়া হতো। এক হিসাবে ২৫ বছরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাচার এই টাকার পরিমাণ ছিল ২৬০ কোটি ডলার।

উচ্চশিক্ষা, সরকারি চাকরি এবং সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রবেশ কঠিন ছিল। এমনকি ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ৬০০০ অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩০০ জন ছিলেন বাঙালি। এ ধরনের অব্যাহত বৈষম্য এবং নিপীড়নের ফলে বাঙালিরা ধীরে ধীরে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও দৃঢ় হয়।

বাঙালিদের এমন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হতো, যেখানে ̧রুত্বপূর্ণ জাতীয় সিদ্ধান্ত হয় না।

বাঙালিদের সংস্কৃতির ওপরও হামলা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে রবীন্দধনাথ ঠাকুরের সাহিত্য কর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করা হয় এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অনেক শব্দ উর্দু

করে প্রকাশ করা হয়। বছরের পর বছর ধরে এই অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক-সংস্কৃতির নির্যাতন বাঙালিদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

পাকিস্তানের  স্বাধীনতার পরের ২৫ বছর সেই প্রভু-সুলভ মনোভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে পদে পদে। সেই সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমাগত বেড়েছে এবং বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের বন্যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি কতটা অসহায় এবং ভঙ্গুর। ঐ সাইক্লোনের পর কেন্দধীয় সরকারের ভূমিকা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।

১৯৭১ সালে, এই বৈষম্যের চরম পরিণতি ঘটে। বাঙালিরা তাদের জাতীয় পরিচয় এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পর, জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। এই লড়াই শুধু সামরিক ছিল না, এটি ছিল বাঙালির জাতীয় চেতনা, মর্যাদা
এবং তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।