তৃণমূল খুঁজছে
যুবলীগের ‘ভাবী’ সিন্ডিকেটের কিরন কোথায়?
- সময় ১০:৫৫:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
- / 313
ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আবারও জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্ক। তবে সেটি যতটা না যুবলীগ কেন্দ্রিক তার চেয়ে বেশি যুবলীগ চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ ফজলে শাসম পরশের স্ত্রী এ্যাড. নাহিদ সুলতানা জুথিকে ঘিরেই। তৃণমূল যুবলীগের নেতাকর্মীরাই নাহিদ সুলতানাকে যুবলীগের ভাবী হিসাবেই আখ্যা দিয়েছে তার নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন। ভাবী লীগের মূল হোতা বা ক্যাশিয়ারখ্যাত হাসান সাইদ কিরন এখন কোথায়? এ নিয়ে তৃণমূলে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
উল্লেখ্য, হাসান সাইদ কিরন যুবলীগের কোনো পদে না থাকলেও যুথির আপন ছোট ভাই এবং পরশের একমাত্র শ্যালক পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুরো সংগঠনকেই নিজে নিয়ন্ত্রণ করতেন।
জানা গেছে, শেখ ফজলে শামস পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরপরই শ্যালক কিরনকে পাবনা থেকে ঢাকায় ডেকে আনেন যুথি। কিরনের প্রথম কাজই ছিল, সারাদেশে যুবলীগের (ভাবী লীগের) বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলে বা বললে, অথবা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের ফেসবুক পোস্টে কেউ লাইক বা কমেন্ট করা, জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানালে সেগুলো স্ক্রিনশট সংরক্ষণ করে যুথিকে সরবরাহ করা।
নিভরযোগ্য সূত্র বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে নিশ্চিত করে জানিয়েছে, কেউ মাইনুল হোসেন খান নিখিলের জন্মদিন শুভেচ্চা জানালেও যুথি নিজেই ফোন করে সেই যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে তৃণমূলের কর্মীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। এমনটি কমপক্ষে ৪ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের।
তবে, কিরনের কাজই ছিল গালিগালাজের পর স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। অথবা যুবলীগের অন্য কাউকে দিয়ে ফোন করিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। ‘ভাবী লীগের সভাপতি’ হিসাবে এ্যাড. নাহিদ সুলতানা যুথির অশ্রাব্য গালি শোনার পর থেকেই তারাও খুঁজতেন কিভাবে তাকে ম্যানেজ করে রাজনীতি করা যায়।
শিকারের খুঁজে থাকা কিরন সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে রাজধানীর পুলিশ প্লাজায় ডাকতেন। সেখানে খাবার খাওয়ার পাশাপাশি চলতো রাজনৈতিক নানা আলোচনা। সেখানে এমনো বলতেন কিরন, ‘যুবলীগের চেয়ারম্যান নামে শেখ ফজলে শাসম পরশ ভাই। দুলা ভাইয়ের কথায় সংগঠন চলে না। কিছু করতে হলে আমার বড় বোনকেই ম্যানেজ করে করতে হবে। তারপর দেনাপাওনার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলতো। লেনদেন হতো অন্য কোথাও।
অভিযোগ রয়েছে, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতা আছেন যারা যুথি ভাবীকে দামি আইফোন উপহার দিয়ে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও গোপালগঞ্জের রবিউল ইসলাম এমনই একজন। এছাড়া সারাদেশে যুবলীগের নেতাদের কাছে যুথির প্রিয় খাবারের মেনু ছিল। নদীর বড় বোয়াল মাছ ছিল নাহিদ সুলতানা যুথির প্রিয় মাছ। চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ থেকে শুরু করে হাওরের অনেক নেতাদের কাছে অলিখিত নিয়ম করে দেয়া হয়েছিল, ঢাকায় যেন যুথির বাসায় নিয়মিত মাছ পাঠানো হয়।
মতিঝিল যুবলীগের এক নেতা যার নাম কাজী মামুন, যার বাড়ি মৌলভীবাজারে। যুথিকে উন্নত মানের চা পাতা সাপ্লাই করে তিনি নিজেকের যুবলীগ নেতা পরিচয় দিতেন।
চট্টগ্রামে কর্মীবান্ধব নুরুল আজিম রনিকে অবমূল্যায়ের পেছনে মূল কারণ ছিল ওই অঞ্চলের আরেক যুবলীগ নেতা দিদার। রনিকে ঠেকাতে তিনি ঢাকায় চলে এসেছিলেন শুধু ভাবীকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। চট্টগ্রামের কমিটিতে রনির মতো কেউ সুযোগ না পেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক যুথির মাধ্যমে শেখ ফজলে শামস পরশ এবং কিরণকে উপহার বাগিয়ে নিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই সহযোগী অধ্যাপক এতটাই সুচতুর যে, তিনি যুথীকে ইউরোপের দামি ব্রান্ডের পারফিউম উপহার দিতেন নিয়মিত। পাশাপশি শেখ ফজলে শামস পরশকেও দিয়েছিলেন একটা নান্দনিক ছবি। পরশের পট্রোট যাকে দিয়ে আঁকিয়েছিলেন, তাকেও যোগ্য সম্মানিটুকু দেয়া হয়নি বলে নিশ্চিত হয়েছে বাংলা অ্যাফেয়ার্স। উল্লেখ্য, এই সহযোগী অধ্যাপক, চবির বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগে কর্মরত এবং তার বোন চসিকের সাবেক সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
কিরন যে শুধু যুবলীগের ক্ষমতা দেখিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলেন তেমনটা নয়। শেখ পরশ ও শেখ তাপসের মধ্যেও বিভেদ তৈরি করেছিলেন। সুনিদিষ্ট এমন অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে বাংলা অ্যাফেয়ার্স। কিরনের ছোট মেয়ে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে ক্ষমতা দাপট খাটাতে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে চাপ দেয়া হয় নানা ভাবে। তখন ওই চেয়ারম্যান সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিষয়টি জানালে, তিনি আইন মেনে কাজ করার পরার্মশ দেন। কিন্তু কিরনের বড় মেয়ে যিনি আইন বিভাগে পড়ার সময়ই নিজেকে আইনজীবী হিসাবে পরিচয় দিতেন, তিনি এবং কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে গিয়ে তুলকালাম করেন। এ সংক্রান্ত সকল প্রমাণাদি বাংলা অ্যাফেয়াসের্রর এই প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছে সেখানে উপস্থিত একাধিক সূত্র।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়াম্যানের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তার ব্যক্তিগত সহকারীকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছিল কিরনের বড় মেয়ে রোজা। কিন্তু শেখ ফজলে নূর তাপসের নিষেধ থাকায় অনৈতিক কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন কিরনের মেয়ে।
যুবলীগের ভাবীখ্যাত নাহিদ সুলতানা যুথির অন্যতম প্রধান অর্থ যোগানদাতা ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের শিল্প বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল হাই। তিনি একাধারে ঢাকাস্থ নোয়াখালী ক্লাব ঢাকা লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের (রুলা)’র সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে নাহিদ সুলতানা যুথি সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করতেন। এক বছরের মেয়াদের কমিটিকে তিনি ভাঙতেই দেননি। ঢাকায় যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নেতাকর্মীদের জন্য নাস্তার জন্য বরাদ্দকৃত টাকাও নিয়ে নিতেন যুথি। যা ব্যবহার করা হতো রুলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য- এমন অভিযোগ করেছেন যুবলীগের পার্টি অফিসে কাজ করা দুইজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার বলতে তার কন্যা শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, তিনি এবং শেখ রেহানা ছাড়া কেউ শেখ পরিবারের সদস্য নন। কিন্তু এক যুবলীগেই শেখ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ ফজলে ফাহিম, মুজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী, শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই এবং বিসিবির পরিচালক শেখ সোহেল এবং ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নাঈম (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) এবং নাহিদ সুলতানা যুথি মিলে গড়ে তুলেছিলেন পরিবারকেন্দ্রিক আরেক সিন্ডিকেট। দলের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলকে এক প্রকার কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। যেকোনো কমিটি করার আগে নিজেরা বসে ভাবীর পরামর্শ নিয়ে তারপর নিখিলকে সাইন করিয়ে নিয়ে আসা হতো।
গোপন সূত্র নিশ্চিত করছে, বারবার এমন ঘটনার পর নিজ থেকেই যুবলীগ থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন নিখিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বিষয়টি নিয়ে নিখিল কয়েকবার জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো সমাধান আসেনি। বরং শেখ হাসিনা নিখিলকে সহ্য করার কথা বলতেন। ১১ নভেম্বর ২০২৪ এ সম্মেলন করারও কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ৫ আগস্ট সবকিছুর পট পরিবর্তন হয়ে যায়।
কিরনের হাত থেকে রক্ষা পাননি নোয়াখালীর একজন ব্যারিস্টার। যুবলীগের মহানগর দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হবে এমন আশা দিয়ে কিরন তার কাছ থেকে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টাকা ফেরত চাইলে উল্টো কিরন হুমকি দিতো ওই ভুক্তভোগীকে।
কিরনের পাশাপাশি যুথির অপকর্মের আরেক সঙ্গী এ্যাড. শাকিলা। তারা যেন হরিহর আত্না। বাংলাদেশের যেকোনো জেলায় যুবলীগের সম্মেলন বা কোনো দলীয় কর্মসূচীতে কিরন, তার পরিবারের সদস্য, শাকিলার জন্য বিমানের টিকেট, অভিজাত হোটেল, পানাহারের পরিপূর্ণ ব্যবস্থাসহ প্রটোকল দিতে বাধ্য করা হতো বিভিন্ন জেলার ও অন্যান্য ইউনিটের নেতাদের। তারা বাধ্য হয়েই নিজের পদ পদবীর আশায় সেগুলো করতেন।
নাহিদ সুলতানা যুথি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। কিন্তু আদালত অঙ্গন ছাড়িয়ে যুবলীগের রাজনীতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। নিজের অনুসারীদের নিয়ে গড়েন একটি শক্তিশালী ক্ষমতার কেন্দ্র। যুবলীগের কমিটিতে কোটি কোটি টাকায় পদবাণিজ্য, কমিটি ঝুলিয়ে রাখা, বড় কমিশন আদায় এবং জবর-দখলের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। মাত্র ৫ বছরেই যুবলীগকে চাপে ফেলে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। এমনকি যুবলীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোর করে হতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি।
অভিযোগ রয়েছে, পাবনায় যুথির নিজে একটি বাগান বাড়ি করেছেন। সেটির অবকাঠামোর জন্য ইট সিমেন্ট থেকে শুরু করে বাথটাব পর্যন্ত বিভিন্ন জেলার যুবলীগের নেতাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে তার আপন চাচাতো ভাই যিনি স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। পরবর্তীতে বিষয়টি গণমাধ্যমে চলে আসলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের একজন শীর্ষ নেতার মাধ্যমে নিউজটি সরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। উল্লেখ্য, এই কর্মীবান্ধব নেতাকেও চূড়ান্ত পর্যায়ে অপমান অপদস্ত করা হয়েছিল।
এসব অভিযোগের বিষয়ে নাহিদ সুলতানা যুথির ব্যবহৃত গ্রামীণ ফোনের নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি তিনি হোয়াটসআপ বা অন্য কোনো মাধ্যমেও সক্রিয়া না থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে, যুথির আপন ছোট ভাই হাসান সাইদ কিরনকে ফোন করা হরেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি বিষয়বস্তু উল্লেখ করে তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সেটির প্রতি উত্তর করেননি। তবে তাকে যখন হোয়াটসআপে কল করা হয়েছিল, তখন তিনি অনলাইনেই ছিলেন।