মুজিব কিল্লার নতুন আতঙ্ক ‘বগুড়ার ছাওয়াল’ কাফি
- সময় ১২:১০:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 1154
দুর্যোগ থেকে মানুষ ও গবাদিপশু রক্ষায় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দেশের ১৬ জেলায় ৫৫০টি ‘মুজিব কিল্লা’ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ওই প্রকল্পে সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহেল কাফি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।
গত অক্টোবরে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়া অভিযোগে তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে বিলাসবহুল বাড়ি, একাধিক ফ্ল্যাট, ব্যক্তিগত গাড়ি, চারটি ইটভাটা, সাতটি ডাম্প ট্রাক, দুগ্ধ ও মৎস্য খামার গড়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরেজমিনে কাফির সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বৈষম্যের স্বীকার, ছাত্রলীগ দ্বারা নির্যাতিত। তবে দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসতেই তিনি ‘বগুড়ার ছেলে’ দাবি করে প্রতিবেদককে আওয়ামী লীগের দোষর অবিহিত করে এবং দুর্ব্যবহার করেন। এসময় মুজিব কিল্লা প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযুক্ত অধিকাংশ কর্মকর্তা সেখানে জড়ো হয়। মূলত মুজিব কিল্লায় হাজার কোটি টাকা লোপাটের ব্লু-প্রিন্ট ঢাকার প্রকল্প অফিসেই হয়।
একটি বিশেষ সিন্ডিকেট; যার নেতৃত্বে এই আবদুল্লাহেল কাফি, সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম, সহকারী প্রকৌশলী মবিনুর হোসেন মিলে প্রকল্পে লুটপাট করেছে। এরাই মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নিকট রেইট কোড বিক্রয় ও পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মূল দুর্নীতির কাজটা করেছে। মুজিব কিল্লা আলোর মুখ না দেখার পেছনেও দায়ী করা হয় এ সিন্ডিকেটকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের একজন ঠিকদার বলেন, ডিপিপি অনুমোদনের প্রায় ১ (এক) বছর অতিবাহিত হলেও প্রকল্পের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। প্রকল্পের অগ্রগতি বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রকল্পে নিয়োজিত কয়েকজন প্রকৌশলী ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা ও দুর্নীতির মূল অন্তরায় বলে মনে করেন ঠিকাদার।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ৬ (ছয়) বছর অতিবাহিত হওয়ার পর প্রকল্প নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কারণে ২০২২ সালে ডিসেম্বর মাসে ১০০টি প্রকল্প কমিয়ে ৪৫০টি প্রকল্প সংশোধিত ডিপিপি পাশ করেন।
কাফির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
সরকারী চাকরীজীবি হলেও চাকরীবিধি লঙ্ঘন করে নিজ দপ্তরে নিজের সুপারভিশনে স্ত্রী কাসফিয়া তামান্নার নামে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কার্যাদেশ নেন আবদুল্লাহেল কাফি। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেন। সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়ার পর তার ও পরিবারের সদস্যদের ভাগ্য পাল্টিয়ে ফেলেন। তিনি সেখানে টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল ও আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীদের অনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্বিতীয় স্ত্রী কাসফিয়া তামান্নার নামে মেসার্স কাসিবা কনস্ট্রাকশন নামে লাইসেন্স তৈরি করেন কাফি। আর ওই প্রতিষ্ঠানের নামে সাইক্লোন শেল্টার প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ কাজ হাতিয়ে নেন।
উল্লেখ্য, সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামালকে গত ১৮ আগস্ট রাতে রাজধানীর মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর আগের দিন ঢাকার মোহাম্মদপুরে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩ কোটি ১ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। একই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করা হয়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় কালামারছড়া উচ্চ বিদ্যালয় বহুমুখী ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে নির্মাণ প্রকল্প ও কয়রা উপজেলার অন্য একটি কাজ তার স্ত্রী কাসফিয়া তামান্নার মালিকানাধীন কাসিবা কনস্ট্রাকশনের নামে নিয়ে তদারকি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন আবদুল্লাহেল কাফি।
এছাড়া নামে-বেনামে বিপুল সংখ্যক প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নেন মুজিব কিল্লা প্রকল্পের এই সহকারী প্রকল্প পরিচালক। এভাবে অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়েন।
অভিযোগে বলা হয়, আবদুল্লাহেল কাফির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় তাকে ২০২১ সালে মুজিব কিল্লা প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেসময় তাকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় পদায়ন করা হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, মুজিব কিল্লা প্রকল্পে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার জন্য আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২২ জনকে নিয়োগ দেন কাফি। এর মধ্যে তার ছোট ভগ্নিপতির ভাগ্নে রাউফন আজাদকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে, তার মামাতো ভাই মো. আতিকুর রহমানকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী, বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে তার সহপাঠি মো. টিপু সুলতানকে নোয়াখালী জেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী, কাফির আরেক সহপাঠি মো. রবিউল ইসলামকে ঝালকাঠি জেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী, অন্য সহকারী প্রকৌশলী বাকী বিল্লার শ্যালক মো. সাজ্জাদ নূরকে জামালপুর জেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী, দ্বিতীয় স্ত্রী কাসফিয়া তামান্নার বান্ধবী আতিয়া আক্তারকে ডেন্টাল টেকনিশিয়ান হওয়া স্বত্তেও অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আর এভাবে জ্ঞাত আয়বর্হিভূত অর্থ অর্জন করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর ও দুদকে জমা পড়া অভিযোগে মুজিব কিল্লা প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক আবদুল্লাহেল কাফির ঢাকা ও বগুড়ার বিভিন্ন জায়গায় তার ও পরিবারের নামে বিভিন্ন সম্পত্তির বৃত্তান্ত তুলে ধরা হয়।
সেগুলোর মধ্যে- উত্তরা মডেল টাউনের ১২ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের ৩৫ নম্বর বাড়িতে দুই কোটি টাকা দামের আলিশান ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটিতে তিনটি ফ্ল্যাট, বসিলা র্যাব ক্যাম্পের পিছনে দুটি ফ্ল্যাট, বগুড়া উপশহরে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বহুতলবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে চারটি ইটের ভাটা, সাতটি ড্রাম ট্রাক, চারটি মাটি কাটার ভেকু মেশিন, বগুড়ার গাবতলীর মহেশপুর ইউনিয়নে দুগ্ধ খামার ও কয়েকটি ফিশারি ফার্ম। এছাড়া নিজের ও স্ত্রীর নামে সঞ্চয়পত্রসহ বিপুল অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স। স্কুলছাত্রী মেয়ের যাতায়াতের জন্য রয়েছে ৩০ লাখ টাকা দামের নোয়া গাড়িও।
এছাড়া চাকরিকালে কাফি তার স্ত্রী ও নিজ নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সকল দুর্নীতির অর্থ জমা করেন এবং তার ও স্ত্রী নামে সঞ্চয়পত্রসহ ব্যাপক ব্যাংক ব্যালেন্স রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ‘নিস্তার কেন্দ্র’ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আবদুল্লাহেল কাফি এবার নতুন মিশন শুরু করেছেন। বিগত সরকারের সময় যেসব ঠিকাদার এই প্রকল্পে কাজ করেছেন; তাদেরকে আওয়ামী লীগের দোষর উল্লেখ করে তাদের ফাইল পর্যালোচনা শুরু করেছেন। ঠিকাদারদের অভিযোগ, ফাইল পর্যালোচনার নামে মূলত চাঁদাবাজি শুরু করেছেন এই কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্পটির বর্তমান পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন বাংলা অ্যাফেয়ার্সকে জানান, তিনি এই প্রকল্পে নতুন এসেছেন, তাই বিগত দিনের দুর্নীতির বিষয়টি তিনি এখনো জানেন না।