ঢাকা ০৯:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিয়ানমারে স্বার্থ রক্ষায় তৎপর চীন-ভারত

কূটনৈতিক প্রতিবেদক
  • সময় ০৭:৩১:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫
  • / 19

স্বার্থ রক্ষায় তৎপর চীন-ভারত

মিয়ানমারের চিন, শান, রাখাইনসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর ব্যাপক লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে সম্প্রতি বেশ সফলতা দেখিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বিশেষ করে রাখাইনে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব দিনদিন বেড়েই চলেছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই মিয়ানমারে বিশেষ করে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্যে নিজ নিজ স্বার্থোদ্ধারে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন ও ভারত। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে কিয়াকফিউ স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এসইজেড) নামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং একটি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প দ্রুতই এগিয়ে নিচ্ছে চীন।

এই দুটি প্রকল্প নিয়ে মিয়ানমার সামরিক সরকার গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানী নেপিদোতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী দলের সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠক করে। বৈঠকে জান্তার বিনিয়োগমন্ত্রী কান জও কিয়াকফিউ এসইজেড কনসোর্টিয়াম কোম্পানি লিমিটেড, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিআইটিআইসি কনসোর্টিয়াম এবং জান্তা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্প দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানান।

মিয়ানমারে ভারতের অর্থায়নে নির্মিত সিত্তে বন্দর পরিদর্শনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ও ইন্ডিয়া গ্লোবাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মিয়ানমারে ভারতের অর্থায়নে নির্মিত সিত্তে বন্দর পরিদর্শনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ও ইন্ডিয়া গ্লোবাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

এর দুই দিন পর মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর এবং ইন্ডিয়ান গ্লোবাল লিমিটেডের প্রতিনিধি দল রাখাইনের রাজধানী সিত্তে সফর করেন। তারা ভারতীয় অর্থায়নে চলমান কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট করিডর প্রকল্পের অধীনে তৈরি সিত্তে বন্দরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন। ভারতীয় দূতাবাসের মতে, ২০২৩ সালের মে মাসে চালু হওয়া সিত্তে বন্দর ভারত পরিচালিত অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প।

সিত্তের আশেপাশে সংঘাত সত্ত্বেও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শহরেই রাত কাটান। যেখানে সিত্তে, কিয়াকফিউ ও রামরি- এ তিনটি শহর ছাড়া রাখাইনের বাকি ১৪টি টাউনশিপ আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে।

ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর জান্তা নিযুক্ত রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেইন লিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তারা সিত্তে বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন এবং এটাকে ‘ভারত-মিয়ানমার প্রীতি প্রকল্প’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই প্রকল্প উপকূলীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ ও পর্যটনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনা প্রভাব ঠেকাতে ভারতের যে ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল কালাদান প্রকল্প। আর কিয়াকফিউ প্রকল্পগুলো চীন-মিয়ানমারের পরিকল্পিত ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডরের অংশ যা চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে।

মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর
মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর

বিপরীতে কালাদান প্রকল্পের লক্ষ্য হলো কলকাতা থেকে সিত্তে বন্দর পর্যন্ত সমুদ্র সংযোগ স্থাপন করা। এরপর সিত্তে থেকে কালাদান নদী হয়ে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পালেতওয়া পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন এবং সেখান থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে সড়কপথে যুক্ত হওয়া।

১২ বছর আগে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্থলবেষ্টিত অঞ্চলের বিকল্প পথ তৈরি করার জন্য নেয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও রাখাইন ও চিন রাজ্যে চলমান সংঘাতের কারণে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।

পালেতওয়া এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। শুধু তাই নয়, কালাদান নদীপাড়ের গুরুত্বপূর্ণ শহর পিয়াকতাও, কিয়াকতাও, ম্রাউক-উ, মিনবিয়া ও মেইবনও দখল করেছে গোষ্ঠীটি। এই অবস্থায় বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সিত্তের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক সফর চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতের শক্ত অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

শেয়ার করুন

মিয়ানমারে স্বার্থ রক্ষায় তৎপর চীন-ভারত

সময় ০৭:৩১:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২৫

মিয়ানমারের চিন, শান, রাখাইনসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে জান্তা বাহিনীর ব্যাপক লড়াই চলছে। এই লড়াইয়ে সম্প্রতি বেশ সফলতা দেখিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বিশেষ করে রাখাইনে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় অঞ্চলে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব দিনদিন বেড়েই চলেছে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই মিয়ানমারে বিশেষ করে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ রাখাইন রাজ্যে নিজ নিজ স্বার্থোদ্ধারে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন ও ভারত। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে কিয়াকফিউ স্পেশাল ইকোনমিক জোন (এসইজেড) নামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং একটি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প দ্রুতই এগিয়ে নিচ্ছে চীন।

এই দুটি প্রকল্প নিয়ে মিয়ানমার সামরিক সরকার গত ১৪ জানুয়ারি রাজধানী নেপিদোতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী দলের সদস্যদের সঙ্গে একটি বৈঠক করে। বৈঠকে জান্তার বিনিয়োগমন্ত্রী কান জও কিয়াকফিউ এসইজেড কনসোর্টিয়াম কোম্পানি লিমিটেড, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিআইটিআইসি কনসোর্টিয়াম এবং জান্তা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রকল্প দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানান।

মিয়ানমারে ভারতের অর্থায়নে নির্মিত সিত্তে বন্দর পরিদর্শনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ও ইন্ডিয়া গ্লোবাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মিয়ানমারে ভারতের অর্থায়নে নির্মিত সিত্তে বন্দর পরিদর্শনে ভারতের রাষ্ট্রদূত ও ইন্ডিয়া গ্লোবাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

এর দুই দিন পর মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর এবং ইন্ডিয়ান গ্লোবাল লিমিটেডের প্রতিনিধি দল রাখাইনের রাজধানী সিত্তে সফর করেন। তারা ভারতীয় অর্থায়নে চলমান কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট করিডর প্রকল্পের অধীনে তৈরি সিত্তে বন্দরের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন। ভারতীয় দূতাবাসের মতে, ২০২৩ সালের মে মাসে চালু হওয়া সিত্তে বন্দর ভারত পরিচালিত অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প।

সিত্তের আশেপাশে সংঘাত সত্ত্বেও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শহরেই রাত কাটান। যেখানে সিত্তে, কিয়াকফিউ ও রামরি- এ তিনটি শহর ছাড়া রাখাইনের বাকি ১৪টি টাউনশিপ আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে।

ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর জান্তা নিযুক্ত রাখাইন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেইন লিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে তারা সিত্তে বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন এবং এটাকে ‘ভারত-মিয়ানমার প্রীতি প্রকল্প’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই প্রকল্প উপকূলীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ ও পর্যটনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনা প্রভাব ঠেকাতে ভারতের যে ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’ তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফসল কালাদান প্রকল্প। আর কিয়াকফিউ প্রকল্পগুলো চীন-মিয়ানমারের পরিকল্পিত ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডরের অংশ যা চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে।

মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর
মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত অভয় ঠাকুর

বিপরীতে কালাদান প্রকল্পের লক্ষ্য হলো কলকাতা থেকে সিত্তে বন্দর পর্যন্ত সমুদ্র সংযোগ স্থাপন করা। এরপর সিত্তে থেকে কালাদান নদী হয়ে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের পালেতওয়া পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন এবং সেখান থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যে সড়কপথে যুক্ত হওয়া।

১২ বছর আগে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের স্থলবেষ্টিত অঞ্চলের বিকল্প পথ তৈরি করার জন্য নেয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও রাখাইন ও চিন রাজ্যে চলমান সংঘাতের কারণে সেই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।

পালেতওয়া এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। শুধু তাই নয়, কালাদান নদীপাড়ের গুরুত্বপূর্ণ শহর পিয়াকতাও, কিয়াকতাও, ম্রাউক-উ, মিনবিয়া ও মেইবনও দখল করেছে গোষ্ঠীটি। এই অবস্থায় বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সিত্তের মতো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক সফর চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতের শক্ত অবস্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।