ব্র্যান্ডের নেশায় সৈয়দ আশরাফ!
- সময় ০২:২৯:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি ২০২৫
- / 277
ব্র্যান্ডের নেশায় সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ তিনি। তার নেশাই ছিল রাজনীতি, পেশা হিসাবেও এটাকেই বেছে নিয়েছিলেন। নির্লোভ নিরহংকারী মানুষটিকে সৈয়দ আশরাফ হিসাবেই চিনেন সবাই, কিন্তু রয়েছে কিছু অজানা অধ্যায়। সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে নিয়ে লিখেছেন বাংলা অ্যাফেয়ার্সের বিশেষ প্রতিনিধি ও অনলাইন ইনচার্জ উৎপল দাস
ব্র্যান্ড মানুষের জন্য নয়, মানুষ নিজেই সবচে বড় ব্র্যান্ড। নিজ কর্মগুণে মানুষ ব্র্যান্ড হয়ে উঠেন। ফ্যাশন সচেতন মানুষ বহু দিন থেকেই আভিজাত্য প্রকাশে ব্র্যান্ডকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি ব্যবহার করেন বলেই বস্তুগত বিষয়টি আরো সমৃদ্ধি ও পরিচিতি পেয়েছে। এমন ঘটনার সাক্ষীও হচ্ছেন নিয়মিত।
বিংশ শতাব্দীর কিং অব পপ হিসাবে যাকে তর্কহীন ভাবে মেনে নেয়া হয় তিনি হচ্ছেন মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন। একাধারে তিনি একজন মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, গান লেখক,অভিনেতা, সমাজসেবক এবং ব্যবসায়ী। তাঁরও প্রিয় ব্র্যান্ড ছিল। পোশাক, খাবার থেকে শুরু করে একজন কিংবদন্তির যা যা ব্যবহার্য সবই তার অনুসারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। মাইকেল জ্যাকশনও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ‘Moscato d’Asti’ নামের ইতালিয়ান ব্র্যান্ডের ওয়াইন পান করতেন। এই ব্র্যান্ডটিকে জনপ্রিয় আগেও ছিল। কিন্তু মাইকেল জ্যাকশনের কল্যাণে ইতালিয়ান এই ওয়াইনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণ। ইউরোপ আমেরিকার পর এশিয়াতেও মাইকেল জ্যাকশনে কারণেই এই প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ব্র্যান্ডটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মাইকেল জ্যাকশন ১৫০ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন। অতৃপ্ত আত্না নিয়ে তিনি দেহত্যাগ করেছেন মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে। ৫১ বছরও তিনি পূর্ণ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি এখনো বেঁচে আছেন তাঁর কর্মের মধ্যে। মাইকেল জ্যাকশনের চেয়ে ১৭ বছর বেশি বাঁচার সুযোগ পেয়েছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ৬৭ বছরের জীবনকালে সৈয়দ আশরাফ নিজ কর্মগুণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম সেরা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছিলেন। জীবনের দুই দশক জীবন রক্ষার্থে তিনিও ইউরোপে ছিলেন। সেখানে জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়েই চলেছেন। সে বিষয়ে ইউরোপ আওয়ামী লীগের নেতারা ভালো বলতে পারেন। তবে নিঃসঙ্কোচে তারা বলেন, সৈয়দ আশরাফের রক্তে আওয়ামী লীগ। সৈয়দ নজরুল ইসলামের যোগ্য সন্তান হিসাবে তিনি কাজ করে গেছেন। কখনোই তাকে লোভ লালসা স্পর্শ করতে পারেনি। ক্ষমতার খুব কাছে থেকেও তিনি সেই আগুনে জাপ দেননি জেনেবুঝেই। কারণ পিতার আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হতে চাননি।
দূরদৃষ্টি নিয়ে রাজনীতি করতেন বলেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এখনো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ ব্র্যান্ডের নামগুলোর মধ্যে উচ্চারিত হন। পরিতাপের বিষয় এই যে, তার সময়কালেই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা (প্রতিযোগী) নিজেকে এতটাই সস্তা বানিয়ে ফেলেছিলেন, যা আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলটির সাথে কখনোই খাপ খায় না।
সৈয়দ আশরাফেরও নেশা ছিল বলে মোটামুটি সবাই জানেন। কিন্তু তার নেশা ছিল শিল্পিত নেশা। ব্র্যান্ড তো লাগবেই। সৈয়দ আশরাফ তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এলজিআরডি মন্ত্রী। শিল্পাঞ্চলে চলছে নানামূখী ঝামেলা। পোশাক কারখানা মালিকদের মাথা ঘুরছে। দেশি বিদেশী ষড়যন্ত্র। জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার উপক্রম। তখনকার দিনে নওগাঁর প্রয়াত এমপি ইসরাফিল আলম যেহেতু শ্রমিক নেতা ছিলেন, তার কাছে ছুটে গেলেন বিজিএমইএ-বিকেএমইএ’র নেতারা। কিছুতেই শ্রমিক নেতাদের মানানো যাচ্ছে না। ইসরাফিল আলম দুই দিনের জন্য থামাতে পারলে তৃতীয় দিনই আবারো শ্রম অসন্তোষ যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।
এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) শেখ হাসিনার দারস্থ হন পোশাক শিল্পের মালিকরা। শ্রমিক নেতাদের বোঝাতে এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় কাজ করতে দায়িত্ব দিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। দলের মধ্যে অর্থনীতিবিদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে যখন দায়িত্ব দিলেন, তখন তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যার সামনে ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোশাক মালিকদের বললেন, ‘তোমরা সৈয়দ আশরাফের সাথে দেখা করো; সমাধান হয়ে যাবে।’ মালিকরা পরে গেলেন মহা চিন্তায়। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করবেন?
গণভবন থেকে বের হয়ে কাচুমাচু করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ফোন দিতে লাগলেন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ সহ টেক্সটাইল মিলের অনেক মালিক। কিন্তু তিনি কারো ফোন ধরলেন না। বিষয়টা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে জানাবেন মালিকপক্ষ সেটারও উপায় নেই। অগ্যতা একজন প্রতিনিধিকে পাঠানো হলো মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ মন্ত্রণালয়েও নেই। তিনি ফোনও ধরছেন না। মহাবিপদে পরে মালিকপক্ষ এদিক, সেদিক ভাবতে শুরু করলেন। এলোমেলো ভাবনা নিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। পোশাক মালিকদের ওপর চাপ বাড়ছে তো বাড়ছেই। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে কমপক্ষে ২০ জন কারখানা মালিক ফোন করেছেন।
অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার পর ফোন ধরলেন সৈয়দ আশরাফ। এপাশ থেকে প্রভাবশালী একজন পোশাক শিল্প কারখানার মালিক যিনি পরবর্তীতে এমপি হয়েছেন তিনি বললেন, ‘লিডার, নেত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য বলেছেন, শ্রম অসন্তোষ সমাধানের বিষয়ে। আপনি দয়া করে আমাদের একটু সুযোগ দিন, দেখা করবো, লিডার। আমরা কখন আসবো, লিডার। কি নিয়ে আসবো, লিডার?
অপর প্রান্ত থেকে ধরাজ কণ্ঠে সৈয়দ আশরাফের স্মিত জবাব ছিল। আমাকে এত বার ফোন দিছো কেন? সেটার জবাব আগে দাও। ঠিক রাত ১০ টার দিকে আসো, মিন্টু রোডের বাসায় এসো।’
এই বলে ফোন কেটে দিলেন সৈয়দ আশরাফ। একদিক দিয়ে মহাখুশি পোশাক শিল্পের মালিকপক্ষ, আবার চিন্তায়ও আছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের জন্য কি উপহার নিয়ে যাবেন। ফোন দিলেন কয়েকজনকে, কি নিয়ে যাওয়া যায়? একেকজন একেক বুদ্ধি দিলেন।
ওই রাতে মিটিংয়ের পর দুই দিনের মাথায় হাতিরঝিলের মাঝে অবস্থিত (ভেঙে ফেলা হয়েছে) বিজিএমইএ ভবনে শ্রমিক মালিক পক্ষের বৈঠক ডাকা হলো। শ্রম অসন্তোষ থেমে গেল।
বিজিএমইএ’র কয়েকজন নেতা পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেছেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কানেকটিভিটি সম্পর্কে মানুষের ধারণাই কম। তিনি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে ফোন চালালেন, দায়িত্ব দিলেন আন্তজার্তিক বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কথা বলতে। দেশেরটা তিনি শ্রমিক নেতাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
উপহার হিসাবে সৈয়দ আশরাফ এই কাজের জন্য পোশাক মালিক পক্ষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন তার প্রিয় ব্র্যান্ডের পানীয়। এতেই তিনি খুশি ছিলেন।
রাজনীতিটাই যার নেশা ও পেশা ছিল, তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার প্রিয় ব্র্যান্ডের কথা যারা জানার জানেন। কিন্তু আমজনতার কাছে সেটা প্রকাশ্য হয় না। এখানেই অনন্য সাধারণ ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে গুছিয়ে রেখেই রাজনীতি করে গেছেন জন মানুষের জন্য। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতি তিনি ছিলেন সহনশীল। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নিয়মিত তখন যোগাযোগ হতো। মূলত সৈয়দ আশরাফ নিজেই একটা ব্র্যান্ড ছিলেন, তিনি তার নেশাতেই মগ্ন ছিলেন। তাই মৃত্যুর ৬ বছর পরও সৈয়দ আশরাফ তার কর্মগুণে বেঁচে আছেন বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন মানুষের হৃদয়ে।