ব্যাংকিং খাতের বাতিঘর বিআইবিএম
- সময় ০৭:৫০:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ জানুয়ারি ২০২৫
- / 164
প্রায় দুইশ’ বছর আগে ১৮২২ সালে উপকূলের ওপর দিয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। লন্ডভন্ড হয়ে যায় পুরো উপকূল। তখন ব্রিটিশ সরকার উপকূলের মানুষের ভবিষ্যতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরই মধ্যে একটি ছিল কুতুবদিয়া বাতিঘর। ১৮৪৬ সালে প্রায় ৪০ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এ বাতিঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ২’শ বছর ঘুটঘুটে অন্ধকারেও বঙ্গবপসাগরে চলাচলকারী নৌযানের পথ নির্দেশনা দিয়ে চলেছে। একই পথে হাটছে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রশিক্ষণ, গবেষণা এবং শিক্ষার একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। এই অনবদ্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং শিক্ষাও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে অর্ধশত বছরেরও বেশি সময়। গত ৫০ বছরে বিআইবিএম হয়ে উঠেছে ব্যাংকিং খাতের বাতিঘর।
বিআইবিএম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে ব্যাংক খাত পুর্নগঠনের কাজ শুরু হয়। প্রথম বারের মত প্রায় এক হাজার ব্যাংকার বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য নিয়োগ করা হলেও নবনিযুক্ত অফিসারবৃন্দের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষক কিছু ছিল না। ঢাকা সফররত ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে এ ব্যাপারে সহযোগীতা করার অনুরোধ জানানো হলে তিনি উচ্চ ও মধ্যম পর্যায়ের দক্ষ কিছু ব্যাংকার নির্বাচিত করে ভারতে প্রশিক্ষণে পাঠানোর পরামর্শ দেন। বিভিন্ন ব্যাংকের ১১ জন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রশিক্ষণের চাহিদা পূরণের যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য একটি ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়।
উক্ত ‘টাস্ক ফোর্স’ এর সদস্য ছিলেন (সর্বজনাব) লুৎফর রহমান সরকার, খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ, জনাব আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারী, এ টি এম মাহবুবুল হক, নুরুল ইসলাম, মুস্তফা ওয়াইজ, এম আমির উদ্দিন, আমিনুল ইসলাম, এ বি এম আনোয়ারুল ইসলাম, হারুনুর রশীদ এবং ইউসুফ এ. হাসান। ‘টাস্ক ফোর্স’ এর সদস্যবৃন্দ ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-এ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরার পর ‘টাস্ক ফোর্স’ সদস্যরা, সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন কয়েকজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, বিশেষতঃ ডেপুটি গর্ভনর এ.কে. গঙ্গোপাধ্যায় উদ্যোগ নেন একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের। নাম ঠিক হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। প্রতিষ্ঠালগ্নে বিআইবিএম গর্ভনিং বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর এ,এন, হামিদ উল্লাহ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা সৈয়দ আলী কবিরকে প্রথম পরিচালক (প্রধান নির্বাহী) নিযুক্ত করা হয়। খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ সর্বপ্রথম অনুষদ সদস্য হিসেবে ব্যাংক থেকে যোগদান করেন। তখনও পর্যন্ত সুসংবদ্ধ কোন কাঠামো গড়ে উঠেনি। প্রশিক্ষণের জন্য কোন উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। জায়গার অভাবের কথা শুনে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের বোর্ডরুমকে ক্লাশরুম হিসেবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়। এটি ছিল অস্থায়ী ব্যবস্থা। সৈয়দ আলী কবিরের পরে এম এ খান পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। শিল্প ব্যাংকের বোর্ডরুমে কয়েক মাস কাজ চালানোর পর বাংলাদেশ ম্যানেজমেন্ট ডেভলপমেন্ট সেন্টার (বিএমডিসি) এর তৎকালীন পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বিআইবিএম এর প্রশিক্ষণের জন্য বিএমডিসি ভবনে দুটি রুমের ব্যবস্থা করেন। স্থান সংকুলানের সমস্যা তীব্র হওয়ায় খোঁজ চলতে থাকে। অবশেষে সদরঘাটে (জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন) একটি ভবন বিআইবিএম এর জন্য নির্ধারিত হয় (বর্তমানে এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারী ভবন)। তখনও পর্যন্ত কোন বাজেট ছিল না। বিএমডিসি এর অনুষদ সদস্যবৃন্দ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তখন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী পরিচালনার জন্য বিনা সম্মানীতে বিআইবিএমকে সহযোগীতা করতেন। ১৯৭৭ সালে বিআইবিএম সদরঘাট থেকে সিদ্ধেশ্বরীতে স্থানান্তরিত হয়। বিআইবিএম এর বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮০ সালের দিকে নিজস্ব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৮৪ সালে বিআইবিএম মিরপুরে নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়।
বিআইবিএম ৫০ বছরের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, শুভানুধ্যায়ী, গুণী এবং বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সহযোগিতা পেয়েছে। শুধুমাত্র তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতাই বিআইবিএম প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেনি, নতুন জন্ম নেয়া একটি রাষ্ট্রকে কার্যকর করে গড়ে তোলার একান্ত আগ্রহে এসব বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত আবেগ, ইচ্ছা- সর্বোপরি তাঁদের দূরদর্শিতা স্বল্প সময়ের মধ্যে বিআইবিএম এর যাত্রাপথকে সাবলীল করেছে, অর্থবহ করেছে।
বিআইবিএম এর সূবর্ণ জয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা সেই সব বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি জানাই অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকে বিভিন্ন ধরণের ডিপোজিট প্রোডাক্টের বিপরীতে আমানত হিসেবে আছে ১লাখ ৬২ হাজার ৩১৩ বিলিয়ন টাকা। অন্যদিকে ১ লক্ষ ৯০ হাজার ১৬২ বিলিয়ন টাকা ঋণ প্রদান করেছে গ্রাহকদের। যেখানে প্রায় ৬ কোটি গ্রাহকের ব্যাংক ও আর্থিক সেবা (মোবাইল ব্যাংকিংসহ) সংক্রান্ত হিসাব রয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে ব্যাংকে কর্মরত প্রায় আড়াই লক্ষ কর্মকর্তা এবং কর্মচারী। আর ব্যাংকিং খাতের এতো বড়ো পোর্টফোলিও যার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকলেও ব্যাংকিং শিক্ষা বিস্তারের এক মহান দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিয়ে চলেছে বিআইবিএম। ব্যাংকিং শিক্ষার যে ট্রেন ১৯৭৪ সালে চালু হয়েছে তা ৫০ -এ এসে গতি কমেনি বরং বেড়েছে বহুগুণ। ছোট পরিসরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে শুরু হওয়া বিআইবিএম এখন ব্যাংকিং খাতের দক্ষিণ এশিয়ার একটি পরিচিত প্রতিষ্ঠান। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হওয়া আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলনে। যেখানে প্রায় অর্ধশত দক্ষিণ এশীয় ব্যাংকাররা, শিক্ষাবিদসহ আর্থিক খাতের বিভিন্ন পর্যায়ের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা যোগদান করেন। একইভাবে ব্যাংকিং সম্মেলনেও ইউরোপ আমেরিকার প্রতিনিধিদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। সর্বশেষ বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন যা পুরো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মানুষের মিলন মেলায় যোগ দেন বিখ্যাত ঋণমান সংক্রান্ত মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠান মুডিস এ্যানালিটকসের প্রধান আরী লিহাবী। আরও চমক সাসটেইনেবল ব্যাংকিং কনপারেন্সে। যেখানে যোগদান করেন বিশ্বখ্যাত টেকসই ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্বসেরা এক্সপার্টরা। জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল কিংবা জিআইজেড-এর সরব উপস্থিতি প্রমাণ করে দেয় বিআইবিএম অনেক পেশাদারিত্বের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। মালয়েশিয়ার বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইশরা বিআইবিএম-কে তাদের আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে প্যানেল আলোচক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়মিত আমন্ত্রণ জানাছে। বিশ্বের সেরা লাইব্রেরীর একটি জার্মান ন্যাশনাল লাইব্রেরী। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে যাদের অবস্থান ৮ম। যেখানে সাড়ে চার কোটি বই এবং প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ পাঠক জার্মান ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে পড়তে যান। সেই লাইব্রেরীর জেষ্ঠ্য কর্মকর্তারা আগ্রহ সহকারে বিআইবিএম-এর ত্রৈমাসিক জার্নাল ‘ব্যাংক পরিক্রমা’ সংগ্রহ করতে ফোন দেন। তখন বিআইবিএম-এর একজন কর্মী হিসেবে গর্বে বুকটা ভরে যায়। বর্তমানে ইউপিএল-এর মাধ্যমে জার্মান ন্যাশনাল লাইব্রেরী ‘ব্যাংক পরিক্রমা’ করছেন।
বিআইবিএম-এখন ৫০ পেরিয়ে যাওয়া মধ্যবয়সী নয় বরং নতুন উদ্দীপনায় এগিয়ে চলা দেশের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠান। গতানুগতিক প্রশিক্ষণ কোর্স বা কর্মশালার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রমের ডালপালা মেলে এখন এক বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ১১ টি সার্টিফিকেশন কোর্স, পলিসি ডায়লগ এবং ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো নিয়ে দক্ষ ও বিজ্ঞ স্কলার সম্মানিত অনুষদ সদস্যরা ইন-ডেফথ গবেষণা পরিচালনা করছেন। এতে সম্মানিত অনুষদ সদস্যদের সহযোগিতা করছেন উদীয়মান কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তবে মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (এমবিএম) -এর শিক্ষার্থীরা নিরবিচ্ছিন্নভাবে গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, যা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সার্টিফিকেশন কোর্সগুলো ব্যাংকার, পুলিশসহ বিভিন্ন পেশার পেশাজীবীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ সকল কোর্স করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠছেন তারা। কেউ হচ্ছেন ব্যাংকিং অডিট এক্সপার্ট, আবার কেউ অর্থ পাচার সংক্রান্ত, আবার কেউ বা এসএমই খাত। আর ব্যাংকিং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে মিলছে আন্তুর্জাতিক সনদ। যা প্রদান করছে জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল। যুক্তরাষ্ট্রের মুডিস এ্যানালিটকসও পিছিয়ে নেই, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ২ টি সার্টিফিকেশন কোর্স চলমান রয়েছে। বিশ্বব্যাংক কিংবা বিশ্বব্যাংক গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান আইএফসি’র মতো প্রতিষ্ঠান বিআইবিএম-এর সঙ্গে কাজে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ৯০’র দশকে যখন ব্যাংকিং খাতের টালমাটাল অবস্থা। ঠিক তখনই বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পুরো ব্যাংকিং খাতে বড় ধরণের সংস্কার কর্মসূচী নেয়া হয়। আজকের ব্যাংকিং খাতের বড় ধরণের পরিবর্তনের পিছনে মূলত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সংস্কার কর্মসূচীই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। সেই সংস্কার কর্মসূচীর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল ব্যাংকিং খাতের কর্মীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য মাস্টার্স চালু করা। এরই প্রেক্ষিতে মাস্টার্স অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (এমবিএম) ইভিনিং-এর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। যা ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতের দুর্নিবার প্রতিষ্ঠান বিআইবিএম। কোভিড-১৯-এ যখন বিশ্বব্যাপী থমথমে। চতুর্দিকে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছিল। কবরস্থানগুলোতে লাশের সারি। এমন পরিস্থিতিতেও বিআইবিএম-এর কার্যক্রম থেমে থাকেনি। প্রযুক্তির সহযোগিতায় অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম আরও জোরদার করে। ওই সময়কার প্রশিক্ষণার্থী তালিকা দেখলেই বোঝা যায়, অন-ক্যাম্পাসে যখন ৩০-৩৫ জনের মধ্যে প্রশিক্ষণার্থী থাকে তখন অন লাইন প্লাটফর্মে শতাধিক প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
বিআইবিএম-এর সুনাম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ব্যাংকারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে এমনটা নয়। এর সুনাম এশিয়া কিংবা ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে আফ্রিকার ব্যাংকিং খাতের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। সম্প্রতি আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমন্ত্রণে দেশটির ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রায় মাস খানেক প্রশিক্ষণের জন্য ডাক পান বিআইবিএম-এর অধ্যাপক (সিলেকশন গ্রেড) ড. শাহ মোঃ আহসান হাবীব। নিয়মিত বিরতিতে নেপালে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সেবা দিচ্ছেন ড. শাহ মোঃ আহসান হাবীব। এ ধরণের কার্যক্রমের মাধ্যমে বিআইবিএম অনন্য উন্নতায় পৌঁছে দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচিতি আফ্রিকার দেশটিতেও পৌঁছে গেছে। আফগানিস্তানের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠাসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিআইবিএম। মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ফান্ডে ব্যাংকারদের বাইরে প্রান্তিক পর্যায়ের নারী উদ্যোক্তাদেরও প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজটি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যাতে আগামী দিনে আরও নারী উদ্যোক্তা গড়ে ওঠে। একই সঙ্গে দেশটি অর্ন্তভ’ক্তিমূলক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
বিআইবিএম-এর হিউম্যান রিসোর্স অব ব্যাংকস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। আর বিআইবিএম-এর প্রকাশনা ও জনসংযোগ শাখার হিসেবে নিয়মিত বছরব্যাপী চলমান কোর্স – কর্মশালা (আউট রিচ) এবং সার্টিফিকেশন কোর্স মিলে প্রায় ১ লাখের বেশি ব্যাংকার-কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তবে সিনিয়র লেভেলের প্রশিক্ষণ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন সেমিনার, গবেষণা কর্মশালা, গোলটেবিল আলোচনা, ব্যাংকিং কনফারেন্স কিংবা মেমোরিয়াল লেকচারের হিসাব কষলে মোট প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এ হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতের বড় অংশ এমপ্লয়ী-কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিআইবিএম।
কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ ইনস্টিটিউট (সিএসআই) আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত আর্থিক খাতের পেশাদারদের মানসম্মত এবং উচ্চ-মানের শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ হিসেবে বিআইবিএম প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ ইনস্টিটিউট। এ প্রতিষ্ঠানটি গত ৫৪ বছরে আট লাখেরও বেশি বিশ্বব্যাপী পেশাদারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাদের জনপ্রিয় কোর্সের মধ্যে রয়েছে ‘সার্টিফিকেট ইন স্মল বিজনেস ব্যাংকিং, ‘সার্টিফিকেট ইন ডেরিভেটিভস মার্কেট স্ট্র্যাটেজিস, ‘সার্টিফিকেট ইন ফিক্সড ইনকাম ট্রেডিং অ্যান্ড সেলস এবং ‘সার্টিফিকেট ইন মাইক্রো ইনভেস্টমেন্ট’। কিন্তু সমসাময়িক সময়ের প্রতিষ্ঠান বিআইবিএম আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে সিএসআই-এর মতো অবস্থান করে নিতে পারেনি। ওয়ার্ল্ডের সাম্প্রতিক রিপোর্টগুলো বলছে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রশিক্ষণের শুধু এশিয়ার দেশগুলোতে মার্কেট সাইজ প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এর বড় অংশ দখল করে আছে মালয়েশিয়া এবং ইন্ডিয়া। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ২০০৭ সালে দ্যা নলেজ ইকোনমি অ্যান্ড এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইন সাউথ এশিয়া শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ সংস্থাটি। সেখানে দেখিয়েছে চীন এবং মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ ও ভারত প্রায় ৩০ বছর পিছিয়ে। এর কারণ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা। ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাউথ এশিয়ান জার্নাল অব হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট। সেখানে বাংলাদেশের ২৭৫ জন ব্যাংক কর্মীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা গেছে, যেসব ব্যাংক কর্মী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং যারা প্রশিক্ষণ ছাড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের আউটপুটের মধ্যে অনেক পার্থক্য। বিআইবিএম গত ৫০ বছরে বিভিন্ন ভাবে দেড় লক্ষ ব্যাংকার-কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যখন অনেক বেশি নজর দেওয়া দরকার ঠিক তখন সেই কাজটিই অতন্দ্র প্রহরীর মতো করে যাচ্ছে বিআইবিএম।
লেখক:
মোঃ আল- মামুন খান
সিনিয়র অফিসার (পিপিআর)