বেলুচিস্তানের সম্পদই এর স্বাধীনতার পথে অন্তরায়!

- সময় ১০:২২:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫
- / 58
দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ বেলুচিস্তান। সম্প্রতি এই অঞ্চলটিতে পাকিস্তানের সরকারি বাহিনীর সাথে স্বাধীনতাকামীদের সংঘাত আরো বেড়েছে। বলা হয়ে থাকে, এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ এ অঞ্চলের স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। আর এ নিয়েই এতো সংঘাত!
ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম এই প্রদেশটির আয়তন ৩ লাখ ৪৭ হাজার ১৯০ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ। এটি পাকিস্তানের মোট আয়তনের প্রায় ৪৮ শতাংশ গঠন করেছে।
এটি উত্তর-পূর্বে খাইবার পাখতুনখোয়া, পূর্বে পাঞ্জাব এবং দক্ষিণ-পূর্বে সিন্ধু পাকিস্তানের প্রদেশগুলির দ্বারা সীমাবদ্ধ। যার পশ্চিমে ইরান এবং উত্তরে আফগানিস্তানের সাথে আন্তর্জাতিক সীমানা ভাগ করে; এবং দক্ষিণে আরব সাগর দ্বারা আবদ্ধ।
বেলুচিস্তান অঞ্চলটি মূলত বৃহত্তর ইরানীয় মালভূমির পূর্ব প্রান্ত। এর প্রায় পুরোটাই পর্বতময়। কিছু কিছু পর্বতশৃঙ্গের উচ্চতা ৬০০০ ফুটেরও বেশি। বেলুচিস্তানের ভূমিরূপ ঊষর ও রুক্ষ। বনজঙ্গলের পরিমাণ খুবই কম এবং গাছপালার আকৃতি খর্ব।
বেলুচিস্তানের ৯৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল থাকলেও পোতাশ্রয়ের সংখ্যা খুব কম। দক্ষিণের উপকূলীয় মাকরান এলাকা বাদে বেলুচিস্তানের সর্বত্র উপক্রান্তীয় মহাদেশীয় জলবায়ু বিরাজ করে। শীত ও গ্রীষ্মে তাপমাত্রা চরমে পৌঁছে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুব কম। বাৎসরিক গড়ে মাত্র ২০০ মিমি বৃষ্টিপাত হয়।
তবে বেলুচিস্তানের মাটি খনিজ সম্পদে ভরপুর। সিন্ধ প্রদেশের পরে এই প্রদেশ থেকেই পাকিস্তানের প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যোগান আসে। সম্প্রতি বেলুচিস্তানের চাগাই জেলার রেকো-দিক শহরের কাছে বিশ্বের বৃহত্তম সোনা ও তামার মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে।
রিকোডিক এলাকায় সোনার বড় মজুদ রয়েছে। এখানে প্রায় ২.২ মিলিয়ন টন সোনার আকরিক রয়েছে। সাইনদাক এলাকায়ও সোনার মজুদ রয়েছে। এছাড়া সাইনদাক এলাকায় বিশ্বের বৃহত্তম তামার মজুদগুলির মধ্যে একটি রয়েছে। এখানে প্রায় ৪১২ মিলিয়ন টন তামার আকরিক রয়েছে।
এই প্রদেশের হর্ণাই এলাকায় কয়লার মজুদ রয়েছে। এখানে প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ রয়েছে। ডেগারি ও সোর রেঞ্জ এলাকায় কয়লার মজুদ রয়েছে। মুসাখেল এলাকায় ক্রোমাইটের মজুদ রয়েছে। এখানে প্রায় ১ মিলিয়ন টন ক্রোমাইটের মজুদ রয়েছে। খুজদার এলাকায়ও ক্রোমাইটের মজুদ রয়েছে।
বেলুচিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় জিপসামের মজুদ রয়েছে। এখানে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন টন জিপসামের মজুদ রয়েছে। এছাড়া বেলুচিস্তানে পাওয়া যায় উচ্চ মানের মার্বেল। এখানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন টন মার্বেলের মজুদ রয়েছে।
প্রদেশটির সুই এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুদ রয়েছে। এখানে প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। পিরকোহ এলাকায়ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। বেলুচিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় তেলের মজুদ রয়েছে, যদিও এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।

এছাড়া কোয়েটা এবং পিশিন এলাকায় আপেলের চাষ হয়। এখানে প্রায় ২০০,০০০ টন আপেল উৎপাদিত হয়। খুজদার এবং পান্জগুর এলাকায় খেজুরের চাষ হয়। এখানে প্রায় ১০০,০০০ টন খেজুর উৎপাদিত হয়। জাফরাবাদ এবং নাসিরাবাদ এলাকায় বাদামের চাষ হয়। এখানে প্রায় ৫০,০০০ টন বাদাম উৎপাদিত হয়।
বেলুচিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ হয়। এখানে প্রায় ৫০০,০০০ টন শাকসবজি উৎপাদিত হয়। গদানি এবং ওরমারা এলাকায় মৎস্য সম্পদ রয়েছে। এখানে প্রায় ৫০,০০০ টন মৎস্য উৎপাদিত হয়।
রয়েছে বিশাল বনজসম্পদও। জিয়ারত এবং লোরালাই এলাকায় বনাঞ্চল রয়েছে। এখানে প্রায় ১০০,০০০ হেক্টর বনাঞ্চল রয়েছে। বেলুচিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় নদী এবং ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ রয়েছে। এখানে প্রায় ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানির মজুদ রয়েছে।
এসব প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে বরাবরই পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ বেলুচিস্তান। যদিও বেলুচ নাগরিকরা বরাবরই স্বতন্ত্র একটি দেশের স্বপ্ন দেখে। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। যা পাকিস্তানের জন্য মাথাব্যথার কারণ।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় বেলুচিস্তান স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান বেলুচিস্তানকে জোরপূর্বক নিজেদের সাথে যুক্ত করে। সেই থেকে শুরু হয় বেলুচ জনগণের অসন্তোষ।
১৯৭০-এর দশকে বেলুচিস্তানে প্রথম বৃহৎ বিদ্রোহ দেখা দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু বেলুচ জনগণের মনে রয়ে যায় ক্ষোভ। এরপর ১৯৭৩ এবং সর্বশেষ ২০০৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত, একের পর এক বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান সরকার।
এই অঞ্চল দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বয়ে গেছে। যাকে পাকিস্তানের অর্থনীতির লাইফলাইনও বলা হয়। পাকিস্তান সরকার গোয়াদারে চীনা সহায়তায় একটি বড় বন্দর ও নৌঘাঁটি নির্মাণ কাজ চলছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউরোপের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। গোয়াদর বন্দর চীনের জন্য একটি কৌশলগত স্থান, যা তার “ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড” উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তবে, এই সম্পদ ও কৌশলগত গুরুত্বের কারণে বেলুচিস্তান আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বেলুচ জনগণ তাদের সম্পদে ন্যায্য অধিকার চায়, যা পাকিস্তান সরকার এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই অঞ্চলে বিদেশী বিনিয়োগ এবং সম্পদ নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিতর্ক রয়েছে।