বাশারবিহীন সিরিয়াতে সংস্কার চলমান
- সময় ১২:৩৩:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 20
মাত্র ১২ দিনের ‘ঝড়ে’ স্বৈরাচার বাশার আল আসাদ সরকারের দুই যুগের শাসনের অবসানের পর সিরিয়া যেন এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ। যে দেশের আনাচকানাচে বাশার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রগুলোতে গুম হওয়া স্বজনদের খোঁজে এখনো ভিড় করছেন হাজারো মানুষ। শুধু সিরিয়া নয়, সারা বিশ্বের মানুষই হতবাক হয়ে পড়ছেন দেশটির কুখ্যাত কারাগারগুলোতে হওয়া নির্মম নির্যাতনের কাহিনি শুনে। গৃহযুদ্ধে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই বেশ ভঙ্গুর অবস্থায়। তবে এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চায় সিরিয়া। নেওয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বেশ কিছু উদ্যোগ। আগের সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ভেঙে দেওয়া এবং সেই কুখ্যাত কারাগারগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা এসেছে। পুলিশ বাহিনীতে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নেওয়া হয়েছে সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগও। দেশটির জনগণ বলছেন, তারা আবার নতুন করে গড়ে তুলতে চান তাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
বিশ্বের যে কোনো দেশেই স্বৈরাচারের পতনের পর আবার নতুন করে দেশ গঠনের একটি তোড়জোড় শুরু হয়। কথা বলার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ায় জনআকাঙ্ক্ষার যেন বিস্ফোরণ ঘটে। সিরিয়ায়ও এখন সেরকম অবস্থা। বাশার আল আসাদের দীর্ঘ ২৪ বছরের দুঃশাসন বিশেষ করে ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের পর থেকে দেশটি যেন নরকে পরিণত হয়েছে। সেই নরকের অবসান ঘটাতে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সেই সময় থেকে লড়াই করে আসছে বিদ্রোহী বাহিনী। মাঝে কিছুদিন সেই লড়াই অনেকটা ঝিমিয়ে পড়লেও সম্প্রতি আবার আকস্মিকভাবে মাথাচাড়া দেয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় মাত্র ১২ দিনের অভিযানে একের পর এক শহরের দখল নিয়ে রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হয় বিদ্রোহী বাহিনী।
অভিযানের নায়ক আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বিনা বাধায় দামেস্ক দখল করলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান দেশটির দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী শাসক বাশার আল আসাদ। সেই ১৯৭১ সাল থেকে দেশটি শাসন করছে বাশার পরিবার। বাশারের বাবা প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ ২০০০ সালে মারা যাওয়ার পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে দেশের হাল ধরেন বাশার। শুরুতে বিলেতফেরত বাশার বেশ ভালোভাবে চালিয়ে গেলেও পরে ক্ষমতার মোহ যেন পেয়ে বসে তাকে। কেড়ে নিতে শুরু করেন বিরোধীদের কথা বলার অধিকার। সরকারের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলত, তাদেরই ধরে নিয়ে এসে ঢোকানো হতো কারাগারে। কারাগারগুলো পরিণত হয় এক ধরনের নির্যাতন কেন্দ্রে। ২০১১ সালে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরু হলে কঠোরভাবে তা দমন করা হয়, যার ফলে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এ গৃহযুদ্ধে মারা যায় ৫ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয় ৬০ লাখ মানুষ, যাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরতে শুরু করেছেন। রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় বাশার এতদিন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত জনতার জয়ই যে অবধারিত, তা তার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো।
তবে যুদ্ধ শেষে দেশ পুনর্গঠনের কাজটা যেন আরও কঠিন। আর সে কঠিন কাজটিই শুরু করতে চায় গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। ইতোমধ্যে তার উদ্যোগও শুরু করেছে দেশটি। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ শাসনামলের নিরাপত্তা বাহিনীকে বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছে বিদ্রোহীরা। গত বুধবার এক বিবৃতিতে আসাদ সরকারের সব কারাগার বন্ধ করে দেওয়ার এবং বন্দিদের হত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করারও ঘোষণা দেন তারা। তাদের বিচারও হবে বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়। বুধবার সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এক বিবৃতিতে বলেন, তিনি আগের সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ভেঙে দেবেন এবং কুখ্যাত কারাগারগুলো বন্ধ করবেন। কোনো মানুষ যাতে ভবিষ্যতে গুমের শিকার না হন এবং মানুষ যাতে নির্ভয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, সে ধরনের ব্যবস্থা তৈরি করা হবে। আসাদ সরকারের নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য ন্যায়বিচারের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সুরক্ষিত করার বিষয়টিও তাদের বিবেচনায় আছে বলে বিৃবতিতে জানান জোলানি।
জোলানি বলেন, যে বা যারা বন্দিদের নির্যাতন বা হত্যায় অংশ নিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করা হবে। এ বিষয়ে ক্ষমা করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বলেন, ‘আমরা সিরিয়ায় তাদের বিচার নিশ্চিত করব। যেসব দেশে অপরাধীরা পালিয়ে গেছে, আমরা দেশগুলোকে বলব তাদের হস্তান্তর করতে, যাতে আমরা ন্যায়বিচার পেতে পারি।’ এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল বশিরও বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করা ও এগিয়ে নেওয়াই হবে তার মূল কাজ। আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনামলে সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে নিপীড়ক পুলিশ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি ছিল। এবার সেই পুলিশ বাহিনীতেও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংস্কারেরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সিরিয়ার নতুন সরকারের মুখপাত্র ওবায়দা আরনাউত বলেছেন, সংবিধান সংস্কারের জন্য খুব শিগগির একটি বিচার বিভাগীয় ও মানবাধিকার কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি যেসব প্রস্তাব দেবে সে অনুযায়ী সংবিধানে সংশোধনী আনা হবে।
সিরিয়ার জনগণের জন্য আরেকটি সুখবর হয়ে এসেছে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বাথ পার্টির একটি ঘোষণা। দলটি তাদের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। সিরিয়ার আল ওয়াতান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বাথ পার্টি ঘোষণা করে, জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পার্টির নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দলের সব কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, অস্ত্রসহ দলের সব বস্তুগত সম্পদ স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। প্রসঙ্গত, আরব বিশ্বকে একত্রিত করা এবং পশ্চিমা প্রভাব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত বাথ পার্টি ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দলটির বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠতে থাকে। সরকার ও দল যেন একাকার হয়ে যায়। বাথ পার্টির দলীয় কার্যক্রম স্থগিত রাখার এ ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে।