বাংলাদেশের যে জনগোষ্ঠীতে কোন ভিক্ষুক নেই | Bangla Affairs
০৩:১৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের যে জনগোষ্ঠীতে কোন ভিক্ষুক নেই

আকাশ ইসলাম
  • সময় ০৭:৫৪:৩০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪
  • / 313

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান সিলেট, যা সবুজ পাহাড়, উঁচু নিচু জমি এবং অগণিত নদী-নালা দ্বারা পরিপূর্ণ। এই অঞ্চলের মধ্যেই বসবাস করছে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী পাঙাল।

পাঙাল ধর্মীয় ভাবে মুসলিম কিন্তু জাতিসত্তার বিচারে মনিপুরি। আবার মুসলিম হলেও রীতিনীতিতে তারা মূলধারার বাঙালিদের চেয়ে ভিন্ন। সাংস্কৃতিক ভাবে বরং মনিপুরীদের সাথে তাদের মিল বেশি। যদিও ধর্ম চর্চা থেকে শুরু করে বিয়ে সবই ইসলাম ধর্মমতে তারা পালন করেন। তবে নানান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো তারা উদ্‌যাপন করেন নিজেদের মতো করে।

এছাড়া মসজিদে জুমার খুতবা বা বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনাও তারা করেন পাঙাল ভাষায় এবং নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে তারা বিয়েশাদীও করেন নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে।

পাঙাল স¤প্রদায় প্রধানত সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বাস করে। এই জনগোষ্ঠীটি প্রাচীনকালে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলার অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর থেকে কিছুটা ভিন্ন এবং অনন্য।

পাঙাল জনগোষ্ঠীর নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে, যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি বড় অংশ। তাদের ভাষায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য, কবিতা এবং লোকগান, যা তাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রভাব ফেলে। এই সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাঙালদের একটি অনন্য পরিচয় দেয় এবং তাদের ঐতিহ্যকে জীবিত রাখে।

পাঙাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস এবং রান্নার ধরনও তাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের খাবারে স্থানীয় উপকরণ এবং মসলার ব্যবহার করা হয়, যা তাদের স্বাদের এবং স্বকীয়তার পরিচায়ক।

বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বামডো) এর ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী মণিপুরি মুসলিমদের মোট জনসংখ্যা ১০ হাজার ৯৪৭। এর মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ৬৩৮ ও নারী ৫ হাজার ৩০৯ জন। মোট পরিবার এক হাজার ৯২১টি এবং গ্রাম ৩৩টি।

মণিপুরি মুসলিমদের শিশুদের স্কুল গমন প্রায় শতভাগ কিন্তু উচ্চশিক্ষার হার খুবই কম। আবার মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগের অভাব পাঙাল শিশুদের শিক্ষাগ্রহণে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করে। পারিবারিক পরিসরে তারা মণিপুরি ভাষাতে লালিত-পালিত হয়। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে অনেকেই মানসিক টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়।

২০১৯ সালের বামডোর শিক্ষার্থী জরিপে পাঙালদের উচ্চশিক্ষার যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে মেডিকেলে ৩ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬২ জন, কলেজে ৮৪৬ জন, ডিপ্লোমা ৩৪ জন, উচ্চবিদ্যালয়ে ৮৮৩ জন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯৬৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় মোট ২ হাজার ৯৯৩ জন মণিপুরী মুসলিম শিক্ষার্থী ছিলেন।

মণিপুরি মুসলিম নারীদের প্রধান পেশা বস্ত্র বুনন। পুরুষদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ। আর পুরুষদের নিত্যসঙ্গী ছিল হুক্কা। বামডোর পেশাগত জরিপ ২০১৯ অনুযায়ি চাকরি করছেন ৭৭২, প্রবাসী ৩৭৭ জন, কৃষি ৮৫০ ও অন্যান্য পেশায় ৭০৪ জন রয়েচে।

মণিপুরি মুসলিমদের মধ্যে বর্তমান ক্যাডার সার্ভিসেও কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য ক্যাডারে ১১; শিক্ষায় দুইজন, পুলিশে দুইজন, প্রশাসনে একজন এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারে একজন কর্মকর্তা আছেন। মণিপুরি মুসলিম সমাজে খুব বেশি ধনাঢ্য ব্যক্তি যেমন নেই; ঠিক তেমনি হতদরিদ্র লোকও নগণ্য। প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। তবে এই মুসলিম সমাজে কোনো ভিক্ষুক নেই।

শেয়ার করুন

বাংলাদেশের যে জনগোষ্ঠীতে কোন ভিক্ষুক নেই

সময় ০৭:৫৪:৩০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্থান সিলেট, যা সবুজ পাহাড়, উঁচু নিচু জমি এবং অগণিত নদী-নালা দ্বারা পরিপূর্ণ। এই অঞ্চলের মধ্যেই বসবাস করছে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী পাঙাল।

পাঙাল ধর্মীয় ভাবে মুসলিম কিন্তু জাতিসত্তার বিচারে মনিপুরি। আবার মুসলিম হলেও রীতিনীতিতে তারা মূলধারার বাঙালিদের চেয়ে ভিন্ন। সাংস্কৃতিক ভাবে বরং মনিপুরীদের সাথে তাদের মিল বেশি। যদিও ধর্ম চর্চা থেকে শুরু করে বিয়ে সবই ইসলাম ধর্মমতে তারা পালন করেন। তবে নানান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো তারা উদ্‌যাপন করেন নিজেদের মতো করে।

এছাড়া মসজিদে জুমার খুতবা বা বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনাও তারা করেন পাঙাল ভাষায় এবং নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে তারা বিয়েশাদীও করেন নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে।

পাঙাল স¤প্রদায় প্রধানত সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বাস করে। এই জনগোষ্ঠীটি প্রাচীনকালে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলার অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর থেকে কিছুটা ভিন্ন এবং অনন্য।

পাঙাল জনগোষ্ঠীর নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে, যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি বড় অংশ। তাদের ভাষায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য, কবিতা এবং লোকগান, যা তাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে প্রভাব ফেলে। এই সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাঙালদের একটি অনন্য পরিচয় দেয় এবং তাদের ঐতিহ্যকে জীবিত রাখে।

পাঙাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস এবং রান্নার ধরনও তাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের খাবারে স্থানীয় উপকরণ এবং মসলার ব্যবহার করা হয়, যা তাদের স্বাদের এবং স্বকীয়তার পরিচায়ক।

বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বামডো) এর ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী মণিপুরি মুসলিমদের মোট জনসংখ্যা ১০ হাজার ৯৪৭। এর মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ৬৩৮ ও নারী ৫ হাজার ৩০৯ জন। মোট পরিবার এক হাজার ৯২১টি এবং গ্রাম ৩৩টি।

মণিপুরি মুসলিমদের শিশুদের স্কুল গমন প্রায় শতভাগ কিন্তু উচ্চশিক্ষার হার খুবই কম। আবার মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগের অভাব পাঙাল শিশুদের শিক্ষাগ্রহণে বাড়তি চাপের সৃষ্টি করে। পারিবারিক পরিসরে তারা মণিপুরি ভাষাতে লালিত-পালিত হয়। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে অনেকেই মানসিক টানাপোড়েনের মুখোমুখি হয়।

২০১৯ সালের বামডোর শিক্ষার্থী জরিপে পাঙালদের উচ্চশিক্ষার যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে মেডিকেলে ৩ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬২ জন, কলেজে ৮৪৬ জন, ডিপ্লোমা ৩৪ জন, উচ্চবিদ্যালয়ে ৮৮৩ জন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৯৬৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় মোট ২ হাজার ৯৯৩ জন মণিপুরী মুসলিম শিক্ষার্থী ছিলেন।

মণিপুরি মুসলিম নারীদের প্রধান পেশা বস্ত্র বুনন। পুরুষদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ। আর পুরুষদের নিত্যসঙ্গী ছিল হুক্কা। বামডোর পেশাগত জরিপ ২০১৯ অনুযায়ি চাকরি করছেন ৭৭২, প্রবাসী ৩৭৭ জন, কৃষি ৮৫০ ও অন্যান্য পেশায় ৭০৪ জন রয়েচে।

মণিপুরি মুসলিমদের মধ্যে বর্তমান ক্যাডার সার্ভিসেও কর্মরত আছেন। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য ক্যাডারে ১১; শিক্ষায় দুইজন, পুলিশে দুইজন, প্রশাসনে একজন এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারে একজন কর্মকর্তা আছেন। মণিপুরি মুসলিম সমাজে খুব বেশি ধনাঢ্য ব্যক্তি যেমন নেই; ঠিক তেমনি হতদরিদ্র লোকও নগণ্য। প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর। তবে এই মুসলিম সমাজে কোনো ভিক্ষুক নেই।