প্রতারণায় রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশিরা

- সময় ০৮:৫৪:১২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
- / 17
রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া অনেক বাংলাদেশিকে প্রতারণার মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হচ্ছে। পরে তাদের পাঠানো হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে। এ ভয়াবহ বাস্তবতা সামনে আসে মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখ নামে ২২ বছর বয়সী এক যুবকের মৃত্যুর পর।
ইয়াসিনের পরিবার জানায়, তাকে চীনা কোম্পানিতে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে চাকরি দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। এজন্য তারা বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেন। কিন্তু রাশিয়ায় যাওয়ার পর তাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।
ইয়াসিনের মৃত্যুর খবর দেয় তার এক বন্ধু, যে নিজেও যুদ্ধ করছে। এরপর এক রুশ কমান্ডার ইয়াসিনের মৃত্যুর বিষয়টি পরিবারের কাছে নিশ্চিত করে। এখন তার পরিবার মরদেহ ফেরত চায়, যেন মা শেষবার ছেলেকে দেখতে পারে। এ ঘটনায় মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে ফোন করে অনেকেই তাদের ছেলেদের খোঁজ নিচ্ছেন। তারা জিজ্ঞেস করছেন তাদের ছেলেদেরও যুদ্ধে পাঠিয়ে দওয়া হয়েছে কি না।
শুক্রবার (১১ এপ্রিল) বার্তাসংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
মোহাম্মদ আকরাম হোসেন নামে এক যুবক এএফপিকে জানিয়েছেন কীভাবে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের রাশিয়ায় পাচার করে যুদ্ধ করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, আমাদের কোনো ধারণা ছিল না আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে নেওয়া হবে। আকরাম জানিয়েছেন, তিনি ও তার ভগ্নিপতি একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। তাদের সাইপ্রাসে চাকরি দেয়ার কথা বলেছিল এজেন্সিটি। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের রাশিয়ায় চাকরির প্রস্তাব দেয়া হয়।
তিনি বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিটি জানায় শুধুমাত্র রাশিয়ায় এখন চাকরির ব্যবস্থা আছে ও আমরা এতে রাজি হই। কিন্তু আমরা কখনো ভাবিনি আমাদের এভাবে পরিত্যাগ করা হবে। আকরাম কৌশলে রাশিয়া থেকে পালিয়ে চলে আসতে সমর্থ হন। কিন্তু তার ভগ্নিপতি পালাতে পারেননি। এখন তিনি রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
আকরাম জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে এসে প্রথমে সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে জানান কীভাবে পাচারকারীরা বাংলাদেশিদের পাচার করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি জানিয়েছেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ১০ জনের একটি দলের সঙ্গে ওমরাহ ভিসায় প্রথমে সৌদি আরব যান। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় রাশিয়ায়। আকরাম বলেন, সৌদিতে কয়েক সপ্তাহ থাকার পর, আমরা রাশিয়ায় যাই। ওই সময় আমাদের রুশ ভাষায় একটি চুক্তিপত্র দেওয়া হয়। যেটির কোনো কিছু আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু তাও স্বাক্ষর করি। এরপর আমাদের রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে বাসে করে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমরা রাতটি কাটাই। এরপরের দিন সকালে আমাদের কয়েকজনকে সামরিক পোশাক দেওয়া হয় এবং তাদের যুদ্ধের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তবে যুদ্ধের ময়দানে নেওয়ার আগে সেনেগালের একটি দলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন বলে জানিয়েছেন আকরাম। পরবর্তীতে তিনি দেশেও ফিরে আসেন।
ঢাকার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এসপি মুস্তাফিজুর রহমান এএফপিকে জানিয়েছেন, রাশিয়ায় মানবপাচারের অভিযোগে এক নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও ছয়টি আলাদা মামলা হয়েছে। এ পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত ২৭ মার্চ রুশ সেনাদের হয়ে লড়াইয়ের সময় ২২ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইয়াসিন শেখের মৃত্যু হয়। এরপরই রাশিয়ায় থাকা অন্য যুবকদের আত্মীয়-স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
ইয়াসিনের চাচা আবুল হাশিম এএফপিকে বলেছেন, ইয়াসিনের বন্ধু, যে নিজেও রুশ সেনাদের হয়ে লড়ছে, সে ঈদের সময় আমাদের ফোন করে জানায় ইয়াসিন মারা গেছে। পরবর্তীতে আমরা এক রুশ কমান্ডারের কাছ থেকে ফোন পাই।
আবুল হাশিম বলেছেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইয়াসিনের জন্য তারা এক দালালকে টাকা দিয়েছিলেন। ওই দালাল বলেছিল, ইয়াসিনকে রাশিয়ায় একটি চীনা কোম্পানির ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ দেয়া হবে। কিন্তু ডিসেম্বরে তাকে যুক্ত করা হয় রুশ সেনাবাহিনীতে।
আমরা ইয়াসিনের চাকরির জন্য অনেক টাকা ব্যয় করেছি। এখন আমরা তার মরদেহ পাচ্ছি। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করেছি তার মরদেহ যেন ফেরত আনা হয়। যেন তার মা তাকে শেষ বিদায় জানাতে পারে— যোগ করেন আবুল হাশিম।
মস্কোতে বাংলাদেশের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স ফরহাদ হোসেন এএফপিকে বলেছেন, তারা কয়েক ডজন বাংলাদেশি পরিবারের কাছ থেকে ফোন পেয়েছেন। যারা তাদের ছেলেদের ব্যাপারে তথ্য জানতে চেয়েছেন। তবে ইয়াসিনের মৃত্যুর বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। তিনি জানিয়েছেন, তাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির মৃত্যুর তথ্য আসেনি। তবে এ ব্যাপারে মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স ফরহাদ হোসেন অবশ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশিরা রুশ সেনাদের হয়ে যুদ্ধ করছে। কিন্তু ঠিক কতজন যুদ্ধ করছে সেটি তিনি নিশ্চিত নন। ফরহাদ বলেন, রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে যারা যুদ্ধ করছে তারা রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে। যুদ্ধের আইন মেনে তারা লড়াই করছে।