ঢাকা ০৯:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাহাড়ে জিয়ার ‘নিরপত্তা চশমা নীতি’!

রাজু হামিদ
  • সময় ০৫:২২:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪
  • / 340

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাতারাতি প্রায় ৫৪ হাজার একর ভূমি পানির নিচে ডুবে যায় এবং চামকা, মারমাসহ বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হাজার হাজার পরিবার তাদেও বাড়ি ও জমি হারায়। তাদের প্রচুর কৃষি জমি এই বাঁধের কারণে বিলীন হয়ে যায়। মূলত তখন থেকেই পার্বত্য এলাকায় আন্দোলনের সূত্রপাত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নতুন সরকারের কাছ থেকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। তাদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাদের এই দাবি উপেক্ষিত হয়।

১৯৭২ সালের সংবিধানে পার্বত্য আদিবাসী হিসেবে আলাদা স্বীকৃতি না দিয়ে পুরো জাতিকে একক বাঙালি পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটি পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে ৭২ সালেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন আদায় করা।

এটি ছিলো পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গঠিত একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল। ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গড়ে ওঠে দলটির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী।

আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও তারা বাংলাদেশের মূলভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার লক্ষ্যে লড়াই শুরু করে। এর পেছনে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং আসামের কিছু রাজনৈতিক প্রভাবও কাজ করেছিল। তাছাড়া তারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথেও জড়িয়ে পড়েন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরন শুরু হয়। এ পরিবর্তনের ধারায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তাঁর শাসনামলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা, এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল অন্যতম।

রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে জেনারেল জিয়া যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন নীতি ও সেনাবাহিনী প্রেরন। এই সিদ্ধান্তের আলোচনা যেমনি আছে; তেমনি আছে সমালোচনাও।

বাঙালি পুনর্বাসন নীতি ও সেনাবাহিনী প্রেরন ছাড়াও স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এই বোর্ডের অর্থায়নের ভার ছিলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হাতে। এসব কার্যক্রম সমন্বয়ের ভার ছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে।

সমালোচকরা জিয়াউর রহমানের এই সিদ্ধান্তকে ‘জিয়ার চশমা নীতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর পাহাড়ে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জিয়ার শাসনামলে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর প্রভাব থাকলেও, এটি পাহাড়ের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি সফল হয়নি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এই দীর্ঘকালীন বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা জিয়ার পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিক ফলাফল বলা যেতে পারে।

ওই চুক্তির কিছু কিছু মেনে নেয়া হলেও এখনো অনেক দাবি বাকি আছে। তবে এই চুক্তির পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষোভ ও অসন্তোষ পুরোপুরি শেষ হয়নি।

শেয়ার করুন

পাহাড়ে জিয়ার ‘নিরপত্তা চশমা নীতি’!

সময় ০৫:২২:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০২৪

১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে রাতারাতি প্রায় ৫৪ হাজার একর ভূমি পানির নিচে ডুবে যায় এবং চামকা, মারমাসহ বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হাজার হাজার পরিবার তাদেও বাড়ি ও জমি হারায়। তাদের প্রচুর কৃষি জমি এই বাঁধের কারণে বিলীন হয়ে যায়। মূলত তখন থেকেই পার্বত্য এলাকায় আন্দোলনের সূত্রপাত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নতুন সরকারের কাছ থেকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। তাদের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাদের এই দাবি উপেক্ষিত হয়।

১৯৭২ সালের সংবিধানে পার্বত্য আদিবাসী হিসেবে আলাদা স্বীকৃতি না দিয়ে পুরো জাতিকে একক বাঙালি পরিচয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এটি পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে ৭২ সালেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে একটি সংগঠন গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন আদায় করা।

এটি ছিলো পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য গঠিত একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল। ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গড়ে ওঠে দলটির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী।

আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কথা বললেও তারা বাংলাদেশের মূলভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার লক্ষ্যে লড়াই শুরু করে। এর পেছনে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং আসামের কিছু রাজনৈতিক প্রভাবও কাজ করেছিল। তাছাড়া তারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সাথেও জড়িয়ে পড়েন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরুকরন শুরু হয়। এ পরিবর্তনের ধারায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তাঁর শাসনামলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা, এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল অন্যতম।

রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে জেনারেল জিয়া যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিলো পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন নীতি ও সেনাবাহিনী প্রেরন। এই সিদ্ধান্তের আলোচনা যেমনি আছে; তেমনি আছে সমালোচনাও।

বাঙালি পুনর্বাসন নীতি ও সেনাবাহিনী প্রেরন ছাড়াও স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নে ১৯৭৮ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। এই বোর্ডের অর্থায়নের ভার ছিলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হাতে। এসব কার্যক্রম সমন্বয়ের ভার ছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে।

সমালোচকরা জিয়াউর রহমানের এই সিদ্ধান্তকে ‘জিয়ার চশমা নীতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর পাহাড়ে পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। জিয়ার শাসনামলে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর প্রভাব থাকলেও, এটি পাহাড়ের দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি সফল হয়নি।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এই দীর্ঘকালীন বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যা জিয়ার পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিক ফলাফল বলা যেতে পারে।

ওই চুক্তির কিছু কিছু মেনে নেয়া হলেও এখনো অনেক দাবি বাকি আছে। তবে এই চুক্তির পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষোভ ও অসন্তোষ পুরোপুরি শেষ হয়নি।