গণপূর্ত অধিদপ্তর
পাহাড়সম অভিযোগ নিয়েও স্থায়ী পদোন্নতির তোড়জোড়
- সময় ০৩:০৪:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি ২০২৫
- / 73
গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সংস্থাপন ও সমন্বয়) শহীদুল আলম; তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ তা হাতে গুণে শেষ করা যাবে না। তবুও যথারীতি বহাল রয়েছেন এই কর্মকর্তা।
শুধু তাই নয় প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী শামিম আখতারের শুভদৃষ্টিতে সমন্বয়কের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করছেন। ইতিমধ্যে তাকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে স্থায়ী পদোন্নতির জন্য সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এ বেশ গুঞ্জন চলছে খোদ গণপূর্ত দপ্তরে।
যেসব কীর্তি শহিদুল আলম করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য; গণপূর্ত অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষার ফল গায়েব, নিয়ম বর্হিভূতভাবে দশ বছর লিয়েন ভোগ, বিধি ভেঙ্গে পদোন্নতি, টাকার বিনিময়ে কয়েকজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বদলির আদেশে পূর্ত অফিসে অস্থিরতার জন্ম দেওয়া, মন্ত্রণালয়ের নামে মিথ্যা প্রজ্ঞাপন জারি, বদলী ও নিয়োগ বানিজ্য, এপিপি ও থোক বরাদ্দ নিয়ে বানিজ্য; বেনামে ঠিকাদারী; সরকারি সম্পত্তি দখল; বিদেশে অর্থ পাচার সহ নানাবিধ অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন।
এই কর্মকর্তা দীর্ঘবছর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। বিনা বেতনে দীর্ঘমেয়াদি ছুটি (লিয়েন) নিলেও নিয়মিত বেতন ভাতা ভোগ করেন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হলে তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করে ২০১৬ সালে লিয়েনকালীন সময়ে নেওয়া বেতন ভাতা ফেরত দিয়েছেন। তখনও তার বিরুদ্ধে নূন্যতম কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহন করেনি দপ্তরটি। পদোন্নতিতে তিনি এসব তথ্য গোপন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে বিদেশ থেকে এসে এক বছরের মাথায় ২০২১ সালের ২৩ জুন নিয়মকানুন না মেনে তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। যা তখনও নানা বির্তকের জন্ম দিয়েছিল।
২০২২ সালে তাকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল-চলতি দায়িত্ব) সংস্থাপন ও সমন্বয় পদে বসানো হয়। এবার এই কর্মকর্তাকে স্থায়ীভাবে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির জন্য সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডে প্রস্তাবণা পাঠানো হয়েছে।
একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এসএসবির নীতিমালায় লঙ্ঘনের মত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তার পদোন্নতি প্রস্তাব। প্রস্তাবিত কর্মকর্তার পাঁচ বছরের এসিআর সারসংক্ষেপ ও ফিডার পদে দুই বছর চাকুরির কথা বলা হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত লিয়নের ফলে তার এসিআর হবে দুই বছরের আর ফিডার ও প্রস্তাবকালীন সময়ে তার দুই বছর পূর্ন হয়নি। তবে গণপূর্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাকে স্থায়ী করতে জোর তদবির হচ্ছে।
দীর্ঘ ১৩ বছর অফিস না করে গত পাঁচ বছরে পুরো গণপূর্তকে নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে একের পর এক পদোন্নতি, অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার একাধিক প্রমান থাকার পরেও তার স্থায়ী সুপারিশকে অনৈতিক ও চাকুরিবিধীপরিপন্থি বলছেন গণপূর্ত একাধিক কর্মকর্তা।
তাদের মতে, শুধুমাত্র অনৈতিক সুবিধা দিয়ে শহীদুল আলম বীরদর্পে চাকুরি করছেন; অন্যথায় অনেক আগেই তার চাকুরি চলে যাওয়ার কথা।
শহীদুল আলমের সুপারিশকে ভালোভাবে গ্রহন করেনি অন্য কর্মকর্তারাও। যারা যোগ্য ও এসিআর ঠিক আছে তাদের মধ্যে ওম প্রকাশ নন্দী, ওয়াসিফ আহমেদ ও আবু হাফিন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রস্তাবে নাম থাকা একজন প্রকৌশলী বলেন, তার সাথে তাদের নাম যুক্ত হওয়ার ঘটনায় তারা বিব্রত।
এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, ২০২৩ সালে ১৬৯ জনের নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল গায়েব করার। ওই বছরের ২৭ এপ্রিল ১৬৯টি শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এর মধ্যে রয়েছে অফিস সহায়ক ১১৭ জন, সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান পাঁচ জন, পাম্প হেলপার দুই জন, ইলেকট্রিক হেলপার সাতজন, নিরাপত্তা প্রহরী ৩০জন এবং মালি আটজন।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশী আবেদন করেন। এরপর ২০ মে এবং ২৭ মে লিখিত পরীক্ষা (এমসিকিউ টাইপ) অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ জুন শুরু হয়ে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলে উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা।
চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষা শেষে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক শহিদুল আলম ফলাফল সংরক্ষণ করেন। সেখান থেকেই বিপুলসংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশীর চূড়ান্ত ফল গায়েব হয়ে যায়। নিয়োগ কমিটির অন্য সদস্যরা জানার পর ফল গায়েবের বিষয়টি আলোচনায় আসে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের ফলাফল সাধারণত সিলগালা করে ট্রাঙ্কে তালা মেরে নির্দিষ্ট কক্ষে সংরক্ষণ করা হয়। সেখান থেকে নির্ধারিত কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া এসব শিট অন্য কারও দেখার সুযোগ নেই। এমনকি এগুলো কোথায় রাখা হয়, তাও কারও জানার কথা নয়। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী শামিম আখতারের কারনে সেই ফলাফল গায়েবের অভিযোগ থেকেও নিস্তার পান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল আলম।
এর আগে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আলমের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অসাধারণের জন্য বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে ঠিকাদার সমিতি অবস্থান কর্মসূচিও পালন করে। তখন ঠিকাদাররা অভিযোগ করেন, ঘুপচি টেন্ডার, সিন্ডিকেট, নির্মাণ সামগ্রি কেনার ব্র্যান্ড নির্ধারণ ও ঠিকাদার সমিতিকে এরিয়ে গিয়ে অপেশাদার ঠিকাদার নিয়োগ করেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) ফয়জুল কবির শিহাব তার ঘুষ লেনদেন হিসেব নিকাশ করেন বলেও জানান ঠিকাদাররা।
এদিকে গত ১৮ নভেম্বর ‘জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় অর্থ সহায়তা দেয়ার অভিযোগে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী ও এই কর্মকর্তার অপসারন চেয়ে সচেতন ছাত্র সমাজের ব্যানারে মানবন্ধন করা হয়। যেখানে দাবি করা হয়, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থাণে অর্থসহায়তা করার অভিযোগে রামপুরা থানায় একটি মামলাও করা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন মন্তব্য করেননি।