০১:১১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫, ২২ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পারমাণবিক অস্ত্রের পাহারায় ডলফিন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • সময় ১০:২৬:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫
  • / 18

পারমাণবিক অস্ত্রের পাহাড়ায় ডলফিন

বর্তমান বিশ্বে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিটি দেশই নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পরাশক্তি চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশ এখন গুরুত্ব দিচ্ছে পারমাণবিক শক্তি বাড়ানোর উপর। অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি এর রক্ষণাবেক্ষণেও জোর দিচ্ছে দেশগুলো।

বিশ্ব পরাশক্তিগুলো প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার সামরিক খাতে ব্যয় করে। আর এসব অস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার জন্যও থাকে হাজারো ব্যবস্থা।

তবে এত কিছুর মাঝে যে কথাটি শুনলে চোখ কপালে উঠবে সেটি হলো পরাশক্তি আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্র পাহারা দেবার দায়িত্বে থাকে একদল ডলফিন।

হ্যা, ঠিকই শুনেছেন! যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের কিটস্যাপ নৌঘাঁটিতে রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র। আর এসব পারমাণবিক বোমার নিরাপত্তা দিতে ২০১০ সাল থেকে সেখানে সৈনিকের মতো দায়িত্ব পালন করে আসছে একদল ডলফিন ও সী লায়ন। তবে সেখানে সী লায়নের চেয়ে ডলফিনের সংখ্যাই বেশি।

ডলফিনদের এই দায়িত্ব নেওয়া কোনো কল্পকাহিনি নয়, বরং কঠোর প্রশিক্ষণের ফলাফল। ১৯৬৭ সাল থেকে ‘স্পেস এন্ড নেভাল ওয়ারফেয়ার সিস্টেম’, সংক্ষেপে ‘স্পাওয়ার’, প্রশিক্ষিত ডলফিনদের যুদ্ধ এবং নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত করছে।

১৯৯০ সালের দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ডলফিনদের ব্যবহার শুরু হয়। ভিয়েতনাম থেকে ইরাক যুদ্ধ- নানা সংঘাতে তারা রেখেছে অসামান্য অবদান। সময়ের সাথে যুদ্ধ কমলেও, বেড়েছে ডলফিনদের কৌশলী ব্যবহার।

ডলফিনদের রয়েছে ইকোলোকেশন ক্ষমতা – যা একটি প্রাকৃতিক সোনার প্রযুক্তির মতো কাজ করে। এটি তাদের পানির নিচে শত্রু চিহ্নিত করতে এবং বিস্ফোরক শনাক্ত করতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, তারা দ্রুত সংকেত বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং হুমকি প্রতিরোধ করতে পারে।

ডলফিনরা শুধু পাহারাদারই নয়, তারা গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। ডুবন্ত নাবিক উদ্ধার থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া জিনিস শনাক্ত করতেও তারা অত্যন্ত দক্ষ।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য দেশেও প্রাণীদের সামরিক কাজে নিয়োগের উদাহরণ রয়েছে। ২০২১ সালে কম্বোডিয়ায় সামরিক বাহিনীতে ২০টি প্রশিক্ষিত ইঁদুর নিয়োগ দেওয়া হয়। আফ্রিকার তানজানিয়া থেকে আনা এই ইঁদুরগুলো শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির কারণে মাইন শনাক্ত করতে সক্ষম।

গত শতাব্দীর গৃহযুদ্ধের সময় কম্বোডিয়ায় পুঁতে রাখা স্থল মাইনগুলোর কারণে ১৯৭৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৬৪,০০০ মানুষ। ইঁদুরদের ব্যবহার করে এই মাইন অপসারণের কাজ চলছে সফলতার সাথে।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে কাজ করা এসব ডলফিন কেবল প্রশিক্ষণ গ্রহণ নয়; বাহিনীতে তাদেরও রয়েছে বিশেষ পদমর্যাদা এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা। এমনকি তাদের থাকার জন্য রয়েছে কোয়ার্টার। দিন হোক বা রাত, তাদের তীক্ষœ দৃষ্টি এড়িয়ে শত্রুর প্রবেশ প্রায় অসম্ভব।

আমেরিকার পাশাপাশি রাশিয়াও যুদ্ধক্ষেত্রে ডলফিন ব্যবহার করে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের নৌ সেনাঘাঁটি রক্ষা করতে সেখানে ডলফিন মোতায়েন করে।

মূলত যুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ ‘মস্কোভা’ ইউক্রেনের আক্রমণে ধ্বংস হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত রাশিয়ার নৌঘাঁটি সেভাসটোপোল রক্ষার নিমিত্তে রাশিয়া ডলফিনের দুইটি প্রশিক্ষিত দল সেখানে মোতায়েন করে।

রাশিয়ার এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত ইউক্রেন থেকে যে কোনো সময় রাশিয়ার নৌঘাঁটির উপর আক্রমণ আসতে পারে। তাছাড়া ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমাদের সামরিক অস্ত্রের কারণে রাশিয়ার দুশ্চিন্তার বিষয়টি আরো প্রবল হয়েছিল।

সমুদ্রের নিচ দিয়ে আসা ইউক্রেনের সাঁতারু বাহিনী যে কোনো সময় আক্রমণ করতে পারে এমন আশংকাও ছিল। আর এসব কারণে কৃষ্ণসাগরে প্রশিক্ষিত ডলফিন মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়া। প্রশিক্ষিত এসব ডলফিনগুলো রাশিয়ার নৌবাহিনীকে আসন্ন বিপদ শনাক্ত করা ছাড়াও যুদ্ধে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে থাকে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই ডলফিন প্রশিক্ষণের কাজটি শুরু করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত সেভাসটোপোল নৌঘাঁটির দায়িত্ব পায় ইউক্রেন।

২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের পর এ নৌঘাঁটিটি রাশিয়ার অধীনে চলে আসে। ইউক্রেন বারবার সেসব প্রশিক্ষিত ডলফিনকে ফেরত দেওয়ার কথা বললেও রাশিয়া এখনো তা করেনি।

শুধু ইউক্রেন যুদ্ধেই নয়, ২০১৮ সালে সিরিয়া যুদ্ধের সময় টারটাস নৌঘাঁটিতে ডলফিন মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। তবে ডলফিনদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কানাডাভিত্তিক হাকাই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় ডলফিন প্রশিক্ষণের কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১২-২০১৯ সালের মধ্যে ৭ কোটি ডলার খরচ করেছিল। রাশিয়ার ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য এখনো জানা যায়নি।

শেয়ার করুন

পারমাণবিক অস্ত্রের পাহারায় ডলফিন

সময় ১০:২৬:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫

বর্তমান বিশ্বে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে প্রতিটি দেশই নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়ানোয় জোর দিচ্ছে। বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পরাশক্তি চীন, রাশিয়াসহ অনেক দেশ এখন গুরুত্ব দিচ্ছে পারমাণবিক শক্তি বাড়ানোর উপর। অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি এর রক্ষণাবেক্ষণেও জোর দিচ্ছে দেশগুলো।

বিশ্ব পরাশক্তিগুলো প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার সামরিক খাতে ব্যয় করে। আর এসব অস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার জন্যও থাকে হাজারো ব্যবস্থা।

তবে এত কিছুর মাঝে যে কথাটি শুনলে চোখ কপালে উঠবে সেটি হলো পরাশক্তি আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্র পাহারা দেবার দায়িত্বে থাকে একদল ডলফিন।

হ্যা, ঠিকই শুনেছেন! যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের কিটস্যাপ নৌঘাঁটিতে রয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র। আর এসব পারমাণবিক বোমার নিরাপত্তা দিতে ২০১০ সাল থেকে সেখানে সৈনিকের মতো দায়িত্ব পালন করে আসছে একদল ডলফিন ও সী লায়ন। তবে সেখানে সী লায়নের চেয়ে ডলফিনের সংখ্যাই বেশি।

ডলফিনদের এই দায়িত্ব নেওয়া কোনো কল্পকাহিনি নয়, বরং কঠোর প্রশিক্ষণের ফলাফল। ১৯৬৭ সাল থেকে ‘স্পেস এন্ড নেভাল ওয়ারফেয়ার সিস্টেম’, সংক্ষেপে ‘স্পাওয়ার’, প্রশিক্ষিত ডলফিনদের যুদ্ধ এবং নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত করছে।

১৯৯০ সালের দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ডলফিনদের ব্যবহার শুরু হয়। ভিয়েতনাম থেকে ইরাক যুদ্ধ- নানা সংঘাতে তারা রেখেছে অসামান্য অবদান। সময়ের সাথে যুদ্ধ কমলেও, বেড়েছে ডলফিনদের কৌশলী ব্যবহার।

ডলফিনদের রয়েছে ইকোলোকেশন ক্ষমতা – যা একটি প্রাকৃতিক সোনার প্রযুক্তির মতো কাজ করে। এটি তাদের পানির নিচে শত্রু চিহ্নিত করতে এবং বিস্ফোরক শনাক্ত করতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, তারা দ্রুত সংকেত বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং হুমকি প্রতিরোধ করতে পারে।

ডলফিনরা শুধু পাহারাদারই নয়, তারা গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। ডুবন্ত নাবিক উদ্ধার থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরে হারিয়ে যাওয়া জিনিস শনাক্ত করতেও তারা অত্যন্ত দক্ষ।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য দেশেও প্রাণীদের সামরিক কাজে নিয়োগের উদাহরণ রয়েছে। ২০২১ সালে কম্বোডিয়ায় সামরিক বাহিনীতে ২০টি প্রশিক্ষিত ইঁদুর নিয়োগ দেওয়া হয়। আফ্রিকার তানজানিয়া থেকে আনা এই ইঁদুরগুলো শক্তিশালী ঘ্রাণশক্তির কারণে মাইন শনাক্ত করতে সক্ষম।

গত শতাব্দীর গৃহযুদ্ধের সময় কম্বোডিয়ায় পুঁতে রাখা স্থল মাইনগুলোর কারণে ১৯৭৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৬৪,০০০ মানুষ। ইঁদুরদের ব্যবহার করে এই মাইন অপসারণের কাজ চলছে সফলতার সাথে।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে কাজ করা এসব ডলফিন কেবল প্রশিক্ষণ গ্রহণ নয়; বাহিনীতে তাদেরও রয়েছে বিশেষ পদমর্যাদা এবং উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা। এমনকি তাদের থাকার জন্য রয়েছে কোয়ার্টার। দিন হোক বা রাত, তাদের তীক্ষœ দৃষ্টি এড়িয়ে শত্রুর প্রবেশ প্রায় অসম্ভব।

আমেরিকার পাশাপাশি রাশিয়াও যুদ্ধক্ষেত্রে ডলফিন ব্যবহার করে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে তাদের নৌ সেনাঘাঁটি রক্ষা করতে সেখানে ডলফিন মোতায়েন করে।

মূলত যুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ ‘মস্কোভা’ ইউক্রেনের আক্রমণে ধ্বংস হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত রাশিয়ার নৌঘাঁটি সেভাসটোপোল রক্ষার নিমিত্তে রাশিয়া ডলফিনের দুইটি প্রশিক্ষিত দল সেখানে মোতায়েন করে।

রাশিয়ার এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। প্রথমত ইউক্রেন থেকে যে কোনো সময় রাশিয়ার নৌঘাঁটির উপর আক্রমণ আসতে পারে। তাছাড়া ইউক্রেনকে দেওয়া পশ্চিমাদের সামরিক অস্ত্রের কারণে রাশিয়ার দুশ্চিন্তার বিষয়টি আরো প্রবল হয়েছিল।

সমুদ্রের নিচ দিয়ে আসা ইউক্রেনের সাঁতারু বাহিনী যে কোনো সময় আক্রমণ করতে পারে এমন আশংকাও ছিল। আর এসব কারণে কৃষ্ণসাগরে প্রশিক্ষিত ডলফিন মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়া। প্রশিক্ষিত এসব ডলফিনগুলো রাশিয়ার নৌবাহিনীকে আসন্ন বিপদ শনাক্ত করা ছাড়াও যুদ্ধে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে থাকে।

গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই ডলফিন প্রশিক্ষণের কাজটি শুরু করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত সেভাসটোপোল নৌঘাঁটির দায়িত্ব পায় ইউক্রেন।

২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখলের পর এ নৌঘাঁটিটি রাশিয়ার অধীনে চলে আসে। ইউক্রেন বারবার সেসব প্রশিক্ষিত ডলফিনকে ফেরত দেওয়ার কথা বললেও রাশিয়া এখনো তা করেনি।

শুধু ইউক্রেন যুদ্ধেই নয়, ২০১৮ সালে সিরিয়া যুদ্ধের সময় টারটাস নৌঘাঁটিতে ডলফিন মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। তবে ডলফিনদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কানাডাভিত্তিক হাকাই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয় ডলফিন প্রশিক্ষণের কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১২-২০১৯ সালের মধ্যে ৭ কোটি ডলার খরচ করেছিল। রাশিয়ার ব্যয় সংক্রান্ত তথ্য এখনো জানা যায়নি।