ঢাকা ০৬:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাক রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এতো প্রভাব কেন!

আকাশ ইসলাম
  • সময় ১০:১৩:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি ২০২৫
  • / 26

পাক রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব

পাকিস্তান- যার অস্তিত্ব শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, বৃটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর। নতুন এই রাষ্ট্রের সূচনার সাথেই শুরু হয় এক অস্বাভাবিক সম্পর্ক সেনাবাহিনী এবং রাজনীতি। যা এখনো চলমান। কিন্তু কিভাবে সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে এতো ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলো?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো ছিল দুর্বল। অন্যদিকে দেশটির সেনাবাহিনী ছিল একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান; কেননা এটি বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে গঠিত হয়।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলেও, এটি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং ফেডারেল সরকারের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে এবং সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৮ সালে, পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন শুরু হয়। তখনকার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। তার নেতৃত্বে। পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনী পুরোপুরি রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে। এরপর থেকে, সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

জন্ম থেকেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ রয়েছে। যা বারবার যুদ্ধ এবং সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। কাশ্মীরের এই অস্থির পরিস্থিতি এবং ভারত- পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা এবং কূটনীতির অন্যতম মুখ।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তা ও কূটনীতির বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনেও। সেনাবাহিনী বিভিন্ন ব্যবসা, শিল্প এবং নির্মাণ ক্ষেত্রেও ব্যাপক অংশগ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর এই ব্যবসায়িক কার্যক্রম রাজনৈতিক শাসনেও তার প্রভাব ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি, শুরু থেকেই নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যা রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার লড়াই সৃষ্টি করেছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী
পাকিস্তান সেনাবাহিনী

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। এই রাজনৈতিক ভুলের কারণে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করেছে। জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র।

এই রাজনৈতিক বিভাজন এবং অনিচ্ছার সুযোগ সেনাবাহিনী নিয়েছিল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাজনৈতিক শূন্যতা এবং বিভাজনের মাঝে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে এক গুরুতর সংকটের জন্ম দেয়।

এছাড়া ১৯৪৭ সালের পর থেকেই, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ধর্মীয় বা আঞ্চলিক মনোভাবকে উস্কে দিয়েছে। যার ফলে দেশটির মধ্যে শিয়া-সুন্নি, বেলুচ-পাঞ্জাবি, সিন্ধি-পশতুন জাতীয় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এই বিভাজন পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ধারা দুর্বল করেছে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়েছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্নীতি একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা। ক্ষমতায় আসার পর, দলগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছে, যা জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। নতুন নেতৃত্বের বিকাশ না হওয়ায়, দলগুলো ঐতিহ্যগত নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে চলেছে, যার ফলে একঘেয়েমি এবং স্থবিরতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতি দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা আরেকধাপ যোগ করেছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো মাঝে মাঝে সামরিক শাসনকে সমর্থন করেছে, বা নীরব সমর্থন দিয়েছে। যা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রভাব দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করেছে এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যা এখনো চলমান আছে।

শেয়ার করুন

পাক রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এতো প্রভাব কেন!

সময় ১০:১৩:১২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারি ২০২৫

পাকিস্তান- যার অস্তিত্ব শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, বৃটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর। নতুন এই রাষ্ট্রের সূচনার সাথেই শুরু হয় এক অস্বাভাবিক সম্পর্ক সেনাবাহিনী এবং রাজনীতি। যা এখনো চলমান। কিন্তু কিভাবে সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে এতো ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলো?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো ছিল দুর্বল। অন্যদিকে দেশটির সেনাবাহিনী ছিল একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান; কেননা এটি বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে গঠিত হয়।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলেও, এটি কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং ফেডারেল সরকারের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে এবং সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৫৮ সালে, পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন শুরু হয়। তখনকার প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। তার নেতৃত্বে। পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনী পুরোপুরি রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে। এরপর থেকে, সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

জন্ম থেকেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ রয়েছে। যা বারবার যুদ্ধ এবং সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। কাশ্মীরের এই অস্থির পরিস্থিতি এবং ভারত- পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা এবং কূটনীতির অন্যতম মুখ।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তা ও কূটনীতির বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, এর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে দেশের অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনেও। সেনাবাহিনী বিভিন্ন ব্যবসা, শিল্প এবং নির্মাণ ক্ষেত্রেও ব্যাপক অংশগ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর এই ব্যবসায়িক কার্যক্রম রাজনৈতিক শাসনেও তার প্রভাব ধরে রাখতে সাহায্য করেছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি, শুরু থেকেই নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যা রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার লড়াই সৃষ্টি করেছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী
পাকিস্তান সেনাবাহিনী

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলেও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। এই রাজনৈতিক ভুলের কারণে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করেছে। জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র।

এই রাজনৈতিক বিভাজন এবং অনিচ্ছার সুযোগ সেনাবাহিনী নিয়েছিল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাজনৈতিক শূন্যতা এবং বিভাজনের মাঝে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, যা দেশের ইতিহাসে এক গুরুতর সংকটের জন্ম দেয়।

এছাড়া ১৯৪৭ সালের পর থেকেই, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ধর্মীয় বা আঞ্চলিক মনোভাবকে উস্কে দিয়েছে। যার ফলে দেশটির মধ্যে শিয়া-সুন্নি, বেলুচ-পাঞ্জাবি, সিন্ধি-পশতুন জাতীয় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এই বিভাজন পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ধারা দুর্বল করেছে। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়েছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্নীতি একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা। ক্ষমতায় আসার পর, দলগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছে, যা জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। নতুন নেতৃত্বের বিকাশ না হওয়ায়, দলগুলো ঐতিহ্যগত নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে চলেছে, যার ফলে একঘেয়েমি এবং স্থবিরতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতি দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা আরেকধাপ যোগ করেছে।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো মাঝে মাঝে সামরিক শাসনকে সমর্থন করেছে, বা নীরব সমর্থন দিয়েছে। যা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। সেনাবাহিনীর শক্তিশালী প্রভাব দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল করেছে এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যা এখনো চলমান আছে।