০১:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে নারীদের নিরাপত্তার অবস্থা উদ্বেগজনক

সিনিয়র প্রতিবেদক
  • সময় ১০:৫৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫
  • / 78

নারীদের নিরাপত্তার

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিটিতে বোরকা ও টি-শার্ট-প্যান্ট পরিহিত দুই নারী লাঠি হাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আন্দোলনের সময়ে তাদের পোশাক নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি, তবে এখন কেন এই বিতর্ক? কেন আজও সমাজে ‘ওড়না গায়ে থাকা বা না থাকার’ বিষয়টি নারীদের জন্য হেনস্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? কেন নিপীড়নকারীকে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়? এসব প্রশ্ন এখন সমাজের নানা স্তরে আলোচিত হচ্ছে।

এক তরুণীর সাক্ষাৎকার সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘২৪ ঘণ্টার জন্য যদি পৃথিবী থেকে সমস্ত পুরুষ উধাও হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘রাতে একা হাঁটতাম, রাত তিনটায় রাস্তায় নেমে দেখতাম কেমন লাগে।’ এই মন্তব্য নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভয়ের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

দেশে নারীদের নিরাপত্তার অবস্থা উদ্বেগজনক। শুধু রাত নয়, দিনের বেলাতেও তাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। জনপরিসর, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, খেলার মাঠ কিংবা ঘর-বাইরে নারীরা নির্যাতন, নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারী নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে কুৎসা রটনা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে জনপরিসরে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করে।

১ মার্চ মোহাম্মদপুরে ‘পাবলিক প্লেসে’ ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে মারধরের শিকার হতে হয়। ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার শিকার হন এক ছাত্রী। অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেও পরদিন জামিনে মুক্ত হয়ে ফুলের মালা ও পাগড়ি পরিয়ে বরণ করা হয়।

নারীর নিরাপত্তাহীনতা
নারীর নিরাপত্তাহীনতা

এছাড়াও, বাসে ডাকাতির সময় নারীদের যৌন নিপীড়ন, নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করার হুমকি, এবং অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংস প্রচারণা সমাজে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের ধারাকে আরও গভীর করেছে। অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা উল্লেখ করেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে নিপীড়নমূলক অপপ্রচার, জনপরিসরে নারী নিপীড়নের ঘটনা এবং সরকারের নীরবতা ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের নতজানু মনোভাব প্রকাশ করছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেনস্তার শিকার ছাত্রী মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে মামলা চালাতে অনিচ্ছুক। মোহাম্মদপুরের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। অধিকারকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এই ধরণের ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সমাজে নারীদের প্রতি সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

নারী ফুটবল নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা আরও উদ্বেগজনক। খুলনার মঙ্গলী বাগচী, যিনি দেড় বছর আগে ফুটবল খেলতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছিলেন, নতুন করে হুমকির মুখে বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। জয়পুরহাট ও রংপুরে নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়েছে স্থানীয় চাপে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেই ১,৪৪০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে। বাস ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা জনমনে গভীর দাগ কেটেছে।

সরকারি পর্যায় থেকে এসব ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য, যেখানে তিনি ধূমপানকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরে আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়েছেন, সেটি জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। নাগরিক সমাজ চাইছে সরকার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিক, যাতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কমানো সম্ভব হয়। মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘পরোক্ষভাবে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। সরকারের অবস্থান দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য।’

এই পরিস্থিতিতে নারী অধিকার আন্দোলন একা সফল হতে পারবে না। শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদই পারে এই সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে

শেয়ার করুন

দেশে নারীদের নিরাপত্তার অবস্থা উদ্বেগজনক

সময় ১০:৫৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিটিতে বোরকা ও টি-শার্ট-প্যান্ট পরিহিত দুই নারী লাঠি হাতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আন্দোলনের সময়ে তাদের পোশাক নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি, তবে এখন কেন এই বিতর্ক? কেন আজও সমাজে ‘ওড়না গায়ে থাকা বা না থাকার’ বিষয়টি নারীদের জন্য হেনস্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়? কেন নিপীড়নকারীকে ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়? এসব প্রশ্ন এখন সমাজের নানা স্তরে আলোচিত হচ্ছে।

এক তরুণীর সাক্ষাৎকার সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘২৪ ঘণ্টার জন্য যদি পৃথিবী থেকে সমস্ত পুরুষ উধাও হয়ে যায়, আপনি কী করবেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘রাতে একা হাঁটতাম, রাত তিনটায় রাস্তায় নেমে দেখতাম কেমন লাগে।’ এই মন্তব্য নারীদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভয়ের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

দেশে নারীদের নিরাপত্তার অবস্থা উদ্বেগজনক। শুধু রাত নয়, দিনের বেলাতেও তাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। জনপরিসর, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, খেলার মাঠ কিংবা ঘর-বাইরে নারীরা নির্যাতন, নিপীড়ন ও হেনস্তার শিকার হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারী নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে কুৎসা রটনা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে জনপরিসরে ঘটে যাওয়া নারী নিপীড়নের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করে।

১ মার্চ মোহাম্মদপুরে ‘পাবলিক প্লেসে’ ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই নারীকে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে মারধরের শিকার হতে হয়। ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার শিকার হন এক ছাত্রী। অভিযুক্ত ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেও পরদিন জামিনে মুক্ত হয়ে ফুলের মালা ও পাগড়ি পরিয়ে বরণ করা হয়।

নারীর নিরাপত্তাহীনতা
নারীর নিরাপত্তাহীনতা

এছাড়াও, বাসে ডাকাতির সময় নারীদের যৌন নিপীড়ন, নারী ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করার হুমকি, এবং অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংস প্রচারণা সমাজে নারীদের প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্যের ধারাকে আরও গভীর করেছে। অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা উল্লেখ করেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে নিপীড়নমূলক অপপ্রচার, জনপরিসরে নারী নিপীড়নের ঘটনা এবং সরকারের নীরবতা ধর্মীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের নতজানু মনোভাব প্রকাশ করছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেনস্তার শিকার ছাত্রী মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত যে মামলা চালাতে অনিচ্ছুক। মোহাম্মদপুরের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। অধিকারকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এই ধরণের ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সমাজে নারীদের প্রতি সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

নারী ফুটবল নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা আরও উদ্বেগজনক। খুলনার মঙ্গলী বাগচী, যিনি দেড় বছর আগে ফুটবল খেলতে গিয়ে মারধরের শিকার হয়েছিলেন, নতুন করে হুমকির মুখে বাসায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। জয়পুরহাট ও রংপুরে নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করা হয়েছে স্থানীয় চাপে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসেই ১,৪৪০টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে। বাস ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা জনমনে গভীর দাগ কেটেছে।

সরকারি পর্যায় থেকে এসব ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য, যেখানে তিনি ধূমপানকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরে আসল সমস্যাকে পাশ কাটিয়েছেন, সেটি জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। নাগরিক সমাজ চাইছে সরকার দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিক, যাতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কমানো সম্ভব হয়। মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘পরোক্ষভাবে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। সরকারের অবস্থান দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য।’

এই পরিস্থিতিতে নারী অধিকার আন্দোলন একা সফল হতে পারবে না। শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রতিবাদই পারে এই সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে