দুষ্প্রাপ্য গিলা ফল ব্যবহার ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

- সময় ০৯:০২:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
- / 46
প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিস্ময়কর উপহার গিলা ফল ( Entada phaseoloides), যা আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের অংশ এবং বহুমুখী ব্যবহারের জন্য পরিচিত। এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং ঔষধিগুণ ও নানাবিধ ব্যবহারিক উপযোগিতার কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একসময় গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে প্রচুর গিলালতা দেখা গেলেও বর্তমানে এটি দুর্লভ হয়ে উঠেছে। বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অজ্ঞতার কারণে এই উদ্ভিদের প্রাপ্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ, এর সংরক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এর সম্ভাবনাময় গুণাগুণ আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।
গিলা লতার বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য
গিলালতা এক ধরনের লতাজাতীয় গাছ, যা প্রাকৃতিকভাবে শিম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এটি ১৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করতে সক্ষম। বনের ভেতরে এটি বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়ে জীবন্ত সেতুর মতো আকৃতি তৈরি করতে পারে। গাছটির কান্ড মোটা ও শক্ত, যা বিভিন্ন গাছকে জড়িয়ে ধরে বাড়তে থাকে।
এর পাতা যৌগিক এবং পত্রফলক ২ থেকে ৬টি পত্রকযুক্ত হয়। মে মাসে সরু ও সাদা পাপড়ির ফুল ফোটে, যা অক্টোবর-নভেম্বরে পরিপক্ব ফল ধারণ করে। প্রতিটি ফলে ১০-১৫টি করে শক্ত, চ্যাপ্টা, লালচে খয়েরি রঙের বীজ থাকে।
বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিতে গিলা ফলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমাদের কৈশোরে-যৌবনে গিলা ফল বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যেত এবং এটি দিয়ে পাঞ্জাবির হাতায় ভাঁজ ফেলা হতো, যা “গিলাকরা পাঞ্জাবি” নামে পরিচিত ছিল। একসময় এটি ফ্যাশনের অংশ ছিল।
দরজিরা কাপড়ে চিহ্ন দেওয়ার জন্য গিলার বীজ ব্যবহার করতেন। দেশের কোথাও কোথাও এখনো গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে গিলার বীজ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ঐতিহ্যবাহী উপকরণ হিসেবে গিলার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
ঔষধিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
গিলালতার ফল ও ছাল ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। চর্মরোগ ও বাহ্যিক ক্ষত গিলার বীজের শাঁস চর্মরোগ, ফোঁড়া, এবং বিভিন্ন ধরণের বাহ্যিক ক্ষত সারাতে ব্যবহৃত হয়। জ্বর নিরাময়ে কার্যকর জ্বর হলে এর নির্যাস পান করলে উপকার পাওয়া যায়। জন্ডিস, দাঁতব্যথা ও আলসার গিলালতার ছাল সেদ্ধ করে সেই ক্বাথ পান করলে জন্ডিস ও আলসার উপশমে সাহায্য করে। প্রকৃতিক কফি ও পরিপাক সহায়ক দক্ষিণ আফ্রিকায় গিলার ফলভাজাকে কফির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক বিরেচক হিসেবেও পরিচিত।
দুষ্প্রাপ্যতা ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
একসময় গ্রামবাংলার প্রায় সব জায়গায় গিলালতা দেখা গেলেও এখন এটি বিলুপ্তির পথে। বন উজাড়, পরিবেশগত পরিবর্তন এবং কৃষিজমির সম্প্রসারণের ফলে এই উদ্ভিদ সংকটে পড়েছে। অথচ, এর বহুমুখী ব্যবহার ও ঔষধিগুণের কথা বিবেচনায় রেখে এই লতাগাছ সংরক্ষণের জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সংরক্ষণে করণীয়
বনায়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তকরণ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গিলালতার সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেখানে গিলালতা জন্মে, সেইসব বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। গবেষণা ও উদ্ভাবন গিলার ঔষধিগুণ নিয়ে আরও গবেষণা করে আধুনিক চিকিৎসায় এর প্রয়োগ বাড়ানো সম্ভব।
সচেতনতা বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলে লোকজ ব্যবহারের প্রচলন টিকিয়ে রাখতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। গিলা ফল শুধু ঐতিহ্য নয়, এটি প্রকৃতির এক দুষ্প্রাপ্য আশীর্বাদ। এর সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এটি আমাদের ঐতিহ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শেয়ার করুন

দুষ্প্রাপ্য গিলা ফল ব্যবহার ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিস্ময়কর উপহার গিলা ফল ( Entada phaseoloides), যা আমাদের লোকজ ঐতিহ্যের অংশ এবং বহুমুখী ব্যবহারের জন্য পরিচিত। এটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নয়, বরং ঔষধিগুণ ও নানাবিধ ব্যবহারিক উপযোগিতার কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একসময় গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে প্রচুর গিলালতা দেখা গেলেও বর্তমানে এটি দুর্লভ হয়ে উঠেছে। বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অজ্ঞতার কারণে এই উদ্ভিদের প্রাপ্যতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। অথচ, এর সংরক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এর সম্ভাবনাময় গুণাগুণ আরও ভালোভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।
গিলা লতার বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য
গিলালতা এক ধরনের লতাজাতীয় গাছ, যা প্রাকৃতিকভাবে শিম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এটি ১৪০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং দ্রুত বিস্তার লাভ করতে সক্ষম। বনের ভেতরে এটি বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে গিয়ে জীবন্ত সেতুর মতো আকৃতি তৈরি করতে পারে। গাছটির কান্ড মোটা ও শক্ত, যা বিভিন্ন গাছকে জড়িয়ে ধরে বাড়তে থাকে।
এর পাতা যৌগিক এবং পত্রফলক ২ থেকে ৬টি পত্রকযুক্ত হয়। মে মাসে সরু ও সাদা পাপড়ির ফুল ফোটে, যা অক্টোবর-নভেম্বরে পরিপক্ব ফল ধারণ করে। প্রতিটি ফলে ১০-১৫টি করে শক্ত, চ্যাপ্টা, লালচে খয়েরি রঙের বীজ থাকে।
বাঙালির লোকজ সংস্কৃতিতে গিলা ফলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আমাদের কৈশোরে-যৌবনে গিলা ফল বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যেত এবং এটি দিয়ে পাঞ্জাবির হাতায় ভাঁজ ফেলা হতো, যা “গিলাকরা পাঞ্জাবি” নামে পরিচিত ছিল। একসময় এটি ফ্যাশনের অংশ ছিল।
দরজিরা কাপড়ে চিহ্ন দেওয়ার জন্য গিলার বীজ ব্যবহার করতেন। দেশের কোথাও কোথাও এখনো গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে গিলার বীজ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বিশেষ করে, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ঐতিহ্যবাহী উপকরণ হিসেবে গিলার উপস্থিতি পাওয়া যায়।
ঔষধিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
গিলালতার ফল ও ছাল ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। চর্মরোগ ও বাহ্যিক ক্ষত গিলার বীজের শাঁস চর্মরোগ, ফোঁড়া, এবং বিভিন্ন ধরণের বাহ্যিক ক্ষত সারাতে ব্যবহৃত হয়। জ্বর নিরাময়ে কার্যকর জ্বর হলে এর নির্যাস পান করলে উপকার পাওয়া যায়। জন্ডিস, দাঁতব্যথা ও আলসার গিলালতার ছাল সেদ্ধ করে সেই ক্বাথ পান করলে জন্ডিস ও আলসার উপশমে সাহায্য করে। প্রকৃতিক কফি ও পরিপাক সহায়ক দক্ষিণ আফ্রিকায় গিলার ফলভাজাকে কফির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক বিরেচক হিসেবেও পরিচিত।
দুষ্প্রাপ্যতা ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
একসময় গ্রামবাংলার প্রায় সব জায়গায় গিলালতা দেখা গেলেও এখন এটি বিলুপ্তির পথে। বন উজাড়, পরিবেশগত পরিবর্তন এবং কৃষিজমির সম্প্রসারণের ফলে এই উদ্ভিদ সংকটে পড়েছে। অথচ, এর বহুমুখী ব্যবহার ও ঔষধিগুণের কথা বিবেচনায় রেখে এই লতাগাছ সংরক্ষণের জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সংরক্ষণে করণীয়
বনায়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্তকরণ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গিলালতার সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করতে হবে। যেখানে গিলালতা জন্মে, সেইসব বনাঞ্চল রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। গবেষণা ও উদ্ভাবন গিলার ঔষধিগুণ নিয়ে আরও গবেষণা করে আধুনিক চিকিৎসায় এর প্রয়োগ বাড়ানো সম্ভব।
সচেতনতা বৃদ্ধি গ্রামাঞ্চলে লোকজ ব্যবহারের প্রচলন টিকিয়ে রাখতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। গিলা ফল শুধু ঐতিহ্য নয়, এটি প্রকৃতির এক দুষ্প্রাপ্য আশীর্বাদ। এর সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এটি আমাদের ঐতিহ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।