মেয়েকে দিয়ে অর্থ পাচার
দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ সাবেক ভ্যাট কমিশনার নুরুজ্জামান

- সময় ০১:২৮:১০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ মার্চ ২০২৫
- / 72
সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামান চাকরিজীবনে দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বলা যায় দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে সবকিছু ধামাচাপা দিয়েছেন এই সাবেক কর্মকর্তা।
জানা গেছে, তিনি ঘুষ ও তদবিরের মাধ্যমে নিজের অপরাধ গোপন রেখে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ফাইলও গায়েব করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি নিজ মেয়েকে দিয়ে অর্থপাচারের অভিযোগও রয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, হাজার কোটি টাকার মালিক নুরুজ্জামান তার অবৈধ সম্পদের বড় অংশ বিদেশে পাচার করেছেন। চাকরির সময় গণভবনের নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং নিতেন তিনি, যাতে তার দুর্নীতির সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত হয়। তার ঘুষ গ্রহণের পরিমাণ ছিল বিশাল—ছোটখাটো অঙ্কের ঘুষ তিনি গ্রহণ করতেন না, বরং মোটা অঙ্কের টাকার জন্যই তার দুর্নীতির চক্র সক্রিয় ছিল।
এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে নগদ অর্থ দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে, একেএম নুরুজ্জামান তার অসাধু কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রশাসনের মধ্যে দুর্নীতির একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামানের বাড়ি ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা থানার শৈলঢুবি গ্রামে হলেও তিনি পরিচয়ের জন্য গোপালগঞ্জের নাম ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন মহলে নিজেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে উপস্থাপন করতেন এবং কথায় কথায় তার নাম বিক্রি করতেন। এছাড়া, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের নাম ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভ্যাট বিভাগে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর, অধীনস্থ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছেও নিজেকে শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত করিয়ে তুলেছিলেন। তার অসাধারণ তদবির ও ম্যানেজমেন্ট ক্ষমতার জন্য তিনি ‘ম্যানেজ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বিশেষ করে, গণভবনের নাম ব্যবহার করে তদবির বাণিজ্যে অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তিনি।
নুরুজ্জামান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের একজন উপদেষ্টা এবং সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী প্রয়াত সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে মামলা মকদ্দমা ও অন্যান্য তদবিরে সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ সালে কাস্টমস সাউথে কর্মরত অবস্থায় তিনি নিজ এলাকার লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের অবৈধভাবে চাকরি দিয়েছেন, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ২০১৩ সালে কমলাপুর আইসিডিতে নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতির অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তিনি। গোপালগঞ্জের পরিচয় ব্যবহার করে সেবারও বিপদ সামলালেও তার ঘুষ বাণিজ্য চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত থেমে থাকেনি।
একটি মামলার নথিপত্র পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় অভিযোগ উঠে যে, নুরুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং বিভিন্ন স্থলবন্দর থেকে রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজার পর্যন্ত চোরাই পণ্যের কারবারি সিন্ডিকেটকে সহায়তা দিতেন। রাজস্ব বিভাগের বন্ড কমিশনারেট, শুল্ক গোয়েন্দা ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানেও তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সে সময় সব অভিযোগ ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন তিনি।
২০১৭ সালের ২০ আগস্ট পুরান ঢাকার গুলশান আরা সিটি মার্কেটের সামনে একটি কাভার্ড ভ্যান থেকে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করে, যেখানে মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সৈয়দ আবিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ও খন্দকার সুরাত আলীকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলার তদন্তে সিআইডি জানতে পারে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শতকোটি টাকারও বেশি শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
এর আগে, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের মাসুদ প্যাকেজিং, মেসার্স ইসলাম অ্যাসোসিয়েটসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভুয়া নথি তৈরি করে ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানির মাধ্যমে চোরাকারবারের অভিযোগে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। একই ধরনের অভিযোগে আদমজী ইপিজেডকেন্দ্রিক মেসার্স আঙ্কেল প্যাকেজিং লিমিটেডের বিরুদ্ধেও মামলা হয়। তদন্তে উঠে আসে, এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যাংক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের আঁতাত ছিল এবং তারা বন্ড জালিয়াতির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।
চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিজানুর রহমান দীপু চাকলাদার ও হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদারের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাঁকি ও চোরাকারবারের অভিযোগ পেয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে। তদন্তের একপর্যায়ে দীপুকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে অপু চাকলাদারের মালিকানাধীন মেসার্স চাকলাদার সার্ভিস ও দীপু চাকলাদারের এমআর ট্রেডিংয়ের সঙ্গে তৎকালীন কাস্টমস কমিশনার একেএম নুরুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি এ সিন্ডিকেটকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
ওই মামলায় দীপু ছাড়াও আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তারা হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী সোহরাব হোসেন ওরফে রিপন, ডেসপাচ শাখার কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম, এআইআর শাখার উচ্চমান সহকারী মাসুম এবং আমদানিকারক মফিজুল ইসলাম লিটন। লিটন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন এবং অপু-দীপুর চোরাকারবার ও শুল্ক ফাঁকির সিন্ডিকেট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। তিনি জবানবন্দিতে সিন্ডিকেটের শেল্টারদাতা হিসেবে একেএম নুরুজ্জামানের নাম প্রকাশ করেন।

তবে নুরুজ্জামান, যিনি চোরাকারবারিদের ছায়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, কখনোই বিচারের মুখোমুখি হননি। প্রভাব খাটিয়ে তিনি নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি তার অবৈধ উপার্জিত বিপুল অর্থ লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করেছেন। একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হলেও ম্যানেজমেন্ট দক্ষতায় নুরুজ্জামান কখনোই জেল হাজতে যাননি, বরং দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের সাম্রাজ্য আরও শক্তিশালী করেছেন।
সাবেক ভ্যাট কমিশনার একেএম নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ২০১১ সালে ঢাকা পূর্ব বন্ড কমিশন কর্মরত থাকাকালীন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরপর ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমসে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বেহিসাবি অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করেন। চট্টগ্রামে থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে কয়েকশ’ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে।
২০২২ সালে পানগাঁও বন্দরে সিগারেট ও মদের কন্টেইনার গায়েবের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় একেএম নুরুজ্জামান আসামি হন। মামলাটি বর্তমানে মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে, যার বাদী ছিলেন সিএন্ডডেএফ কমিশনার এমদাদ। অভিযোগ রয়েছে, মামলার দায় থেকে রেহাই পেতে তিনি গণভবনে গিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব তহবিলে কোটি কোটি টাকা দান করেন। মামলা এড়াতে নানা কৌশল অবলম্বন করায় তাকে “তদবিরবাজ নুরুজ্জামান” নামে পরিচিত হতে হয়।
চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালীন তিনি ১,২০০ কন্টেইনার চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই কন্টেইনারগুলোতে ফেব্রিক্স (কাপড়) ছিল এবং মামলায় তার সঙ্গে আরেক আসামি হিসেবে রয়েছেন সিএন্ডএফ এজেন্ট মিজানুর রহমান, যিনি এমআর ট্রেডিংয়ের মালিক। মামলাটি ধামাচাপা দিতে সাবেক আইনমন্ত্রীকে মোটা অঙ্কের টাকা দিলেও ব্যর্থ হন নুরুজ্জামান, ফলে মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে।
ব্যক্তিগত জীবনে, নুরুজ্জামান ও তার স্ত্রী পাপিয়ার এক ছেলে দাইয়ান ও এক মেয়ে নিশাত রয়েছে। নিশাতের দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছে এবং বর্তমানে তিনি লন্ডনে বসবাস করছেন। অভিযোগ রয়েছে, নুরুজ্জামানের অস্ট্রেলিয়ায় বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও বিপুল সম্পদ রয়েছে। চাকরিকালীন সময়ে তিনি প্রায়শই মেয়ে নিশাতকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশে যেতেন। এ সময়ে নিশাত লাগেজে ডলার ভরে নিয়ে যেতেন, তবে বাবার দাপটের কারণে বিমানবন্দরে কখনো লাগেজ চেক করা হতো না। বরং গোয়েন্দা সংস্থা ও কাস্টমস কর্মকর্তারা বিশেষ সুবিধা দিয়ে ডলার ভর্তি লাগেজ পাস করিয়ে দিতেন। এভাবে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন নুরুজ্জামান ও তার মেয়ে নিশাত।
দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের পাশাপাশি নুরুজ্জামান দেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। রাজধানীর অদূরে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় স্ত্রী পাপিয়ার নামে একটি গার্মেন্টস স্থাপন করেন, যা পরিচালনা করেন তার চাচাতো ভাই মহিউদ্দিন। এছাড়া, তার নামে-বেনামে অসংখ্য সম্পদ রয়েছে। বর্তমানে তিনি ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন। ওই বাড়ির সামনের একটি ফ্ল্যাটে তার শ্যালক হাবিবুর রহমান হেন্ডির থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে।
একেএম নুরুজ্জামারে বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।