ঢাকা ০৯:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৭ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সাড়ে সাতশো চুল্লি গিলে খাচ্ছে পরিবেশ

দীঘিনালায় ইউএনও’র নির্দেশনা মানছে না তামাক চাষীরা

প্রমোদ কুমার মুৎসুদ্দী, দিঘীনালা (খাগড়াছড়ি)
  • সময় ০১:২২:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • / 129

তামাক চুল্লি

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় কয়েক বছরে তামাক চাষ বেড়েছে। এই উপজেলাতেই রয়েছে সাড়ে সাতশোর বেশি তামাক চুল্লি, এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আনন্দ। নিয়ম নীতির তোয়াক্তা না করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি থেকে শুরু করে বসতবাড়িতেও মানা হচ্ছে না নিয়ম। এ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদের নির্দেশও মানছে না তামাক চাষীরা।

দীঘিনালায় ক্ষুদ্র ঋণ, পরিবেশ ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও আনন্দ জানিয়েছে, এই সাড়ে সাতশো তামাক চুল্লির বেশির ভাগই বসতবাড়ির আঙ্গিনায়। জাতীয় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি মানা হচ্ছে না অধিকাংশ চুল্লিতে। শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এমনকি বসতবাড়ি থেকে কমপক্ষে ৫০ ফিট দূরত্বে চুল্লি নির্মাণের অনুমতি থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না।

বসতভিটায় স্থাপিত তামাক চুল্লিগুলোতে নেই কোন প্রকার অগ্নি নির্বাপক ব্যাবস্থা। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর নানা সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

তামাক চুল্লির কারণে উপজেলায় ধান চাষের পরিমাণ দিনদিন কমছে। একই সঙ্গে তামাক চাষে ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহারে চাষিদের চর্মরোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

অবৈধ চুল্লির বিরুদ্ধে দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করলেও পুরোপুরো বন্ধ হচ্ছে না চুল্লিগুলো। পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি পাহাড়ি বন উজাড় করার এক মহোৎসব চলছে দীঘিনালাতে।

সবশেষ উপজেলার হাচিনসনপুর এলাকায় তামাক চুল্লিতে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী কর্মকর্তা। গত (২০ জানুয়ারি) সোমাবার দুপুরের দিকে দীঘিনালা উপজেলার হাচিনসনপুর এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করেন মো. মামুনুর রশীদ। এসময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর (১২) ধারায়, রেনু আক্তার ও আমিন শরিফকে দুইজনকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

ইউএনও মামুন জরিমানার পর হাচিনসনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এবং হাচিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে ১০০ গজ দুরে তামাক চুলা সরিয়ে নেওয়ার নিদের্শ দিয়ে ১০ দিনের সময় বেঁধে দেন। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও তামাক চাষী রেনু আক্তার ও আমিন শরিফ তাদের চুল্লি সরিয়ে নেয়নি। উল্টো তাদের সাথে আরো তিন তামাক চাষীয়কে সঙ্গে নিয়ে জোট করেছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, হাচিনসন পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী উত্তর পাশে আরো তিনটি তামাক চুলা নির্মাণ করা করেছে বিলকিস আক্তার, চান মিয়া এবং মোঃ জাহাঙ্গীর। ২ ফেবুয়ারি বাংলা অ্যাফেয়ার্সের পক্ষ থেকে সরেজমিনে এ বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।

২০ জানুয়ারি তামাক চাষী রেনু আক্তার এবং আমিন শরিফ অঙ্গীকার করেন হাচিনসনপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও হাচিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আরো (বর্তমান অবস্থান থেকে) ১০০ গজ দুরে সরিয়ে নিবেন বলে অঙ্গিকার করেছিলেন। কিন্তু তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আদেশকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না।

জরিমানা এবং ইউএনও মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে অভিযানের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন দীঘিনালা উপজেলার ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা, দীঘিলানা থানা প্রশাসন, দক্ষিণ বন ও পরিবেশ কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সাংবাদিক সোহেল রানা, মোঃ সোহানুর রহমান, মোঃ আক্তার হোসেন, দুর্জয় বড়ুয়া।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ বলেন, তামুক চুলার দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে, স্কুলের কাছ থেকে সরাতে হবে। তা না হলে অবৈধ তামাক চুল্লিগুলো ভেঙে ফেলবে ফায়ার সার্ভিস। জ্বালানি কাঠ ব্যাপারে বন ও পরিবেশ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দীঘিনালা ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিলিভ ডিফেন্সের পংকজ বড়ুয়া বলেন, বলেন দিঘীনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদেরকে লিখিতভাবে দায়িত্ব দেননি। মৌখিকভাবে দিয়েছেন। তবুও আমরা ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়েই দেখছি। বন অধিদপ্তরের বনও পরিবেশ দক্ষিণ বিভাগের দাবি, পাহাড়ে গাছ কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ। গাছ কাটার সাথে যারা জড়িত আছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

তামাক চুল্লিতে দামী কাঠ
তামাক চুল্লিতে দামী কাঠ

এক তামাক চাষী বলেন, একটা তামাক চুলাতে প্রতি মৌসুমে ৮০০ থেকে ১ হাজার মন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে হয়। কাঠগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই দামি কাঠ। অকপটে স্বীকার করে ওই তামাক চাষী বলেন, আম, জাম, গর্জন, সেগুন, কাঁঠাল কাঠসহ বিভিন্ন গাছের কাঠ ব্যবহার করছি।

উল্লেখ্য, দীঘিনালা উপজেলার ৩ নং কবাখালি ইউনিয়নে অবস্থিত ব্রিটিশ টবাকো কোম্পানি কর্তৃক প্রতি বছর তামাক চাষীদের প্রণোদনা দিচ্ছে নিয়মিত। অথচ কোম্পানির পক্ষ থেকে কোন প্রকার নীতিমালা অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়না।

তামাক চাষীদের দাবি, তামাক চুল্লি ব্যবহারে ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ কর্তৃক নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

তামাক চাষীদের চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে গাছের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যাবহারে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে বলে মনে করেন এলাকার সচেতন নাগরিকরা।

শেয়ার করুন

সাড়ে সাতশো চুল্লি গিলে খাচ্ছে পরিবেশ

দীঘিনালায় ইউএনও’র নির্দেশনা মানছে না তামাক চাষীরা

সময় ০১:২২:১৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় কয়েক বছরে তামাক চাষ বেড়েছে। এই উপজেলাতেই রয়েছে সাড়ে সাতশোর বেশি তামাক চুল্লি, এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আনন্দ। নিয়ম নীতির তোয়াক্তা না করেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি থেকে শুরু করে বসতবাড়িতেও মানা হচ্ছে না নিয়ম। এ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদের নির্দেশও মানছে না তামাক চাষীরা।

দীঘিনালায় ক্ষুদ্র ঋণ, পরিবেশ ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিও আনন্দ জানিয়েছে, এই সাড়ে সাতশো তামাক চুল্লির বেশির ভাগই বসতবাড়ির আঙ্গিনায়। জাতীয় তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি মানা হচ্ছে না অধিকাংশ চুল্লিতে। শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এমনকি বসতবাড়ি থেকে কমপক্ষে ৫০ ফিট দূরত্বে চুল্লি নির্মাণের অনুমতি থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না।

বসতভিটায় স্থাপিত তামাক চুল্লিগুলোতে নেই কোন প্রকার অগ্নি নির্বাপক ব্যাবস্থা। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর নানা সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

তামাক চুল্লির কারণে উপজেলায় ধান চাষের পরিমাণ দিনদিন কমছে। একই সঙ্গে তামাক চাষে ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহারে চাষিদের চর্মরোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

অবৈধ চুল্লির বিরুদ্ধে দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করলেও পুরোপুরো বন্ধ হচ্ছে না চুল্লিগুলো। পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি পাহাড়ি বন উজাড় করার এক মহোৎসব চলছে দীঘিনালাতে।

সবশেষ উপজেলার হাচিনসনপুর এলাকায় তামাক চুল্লিতে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার টাকা জরিমানা করেছে দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী কর্মকর্তা। গত (২০ জানুয়ারি) সোমাবার দুপুরের দিকে দীঘিনালা উপজেলার হাচিনসনপুর এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করেন মো. মামুনুর রশীদ। এসময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এর (১২) ধারায়, রেনু আক্তার ও আমিন শরিফকে দুইজনকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

ইউএনও মামুন জরিমানার পর হাচিনসনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এবং হাচিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে ১০০ গজ দুরে তামাক চুলা সরিয়ে নেওয়ার নিদের্শ দিয়ে ১০ দিনের সময় বেঁধে দেন। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও তামাক চাষী রেনু আক্তার ও আমিন শরিফ তাদের চুল্লি সরিয়ে নেয়নি। উল্টো তাদের সাথে আরো তিন তামাক চাষীয়কে সঙ্গে নিয়ে জোট করেছেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, হাচিনসন পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী উত্তর পাশে আরো তিনটি তামাক চুলা নির্মাণ করা করেছে বিলকিস আক্তার, চান মিয়া এবং মোঃ জাহাঙ্গীর। ২ ফেবুয়ারি বাংলা অ্যাফেয়ার্সের পক্ষ থেকে সরেজমিনে এ বিষয়টির সত্যতা খুঁজে পেয়েছে।

২০ জানুয়ারি তামাক চাষী রেনু আক্তার এবং আমিন শরিফ অঙ্গীকার করেন হাচিনসনপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও হাচিনসনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আরো (বর্তমান অবস্থান থেকে) ১০০ গজ দুরে সরিয়ে নিবেন বলে অঙ্গিকার করেছিলেন। কিন্তু তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আদেশকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না।

জরিমানা এবং ইউএনও মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে অভিযানের সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন দীঘিনালা উপজেলার ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা, দীঘিলানা থানা প্রশাসন, দক্ষিণ বন ও পরিবেশ কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সাংবাদিক সোহেল রানা, মোঃ সোহানুর রহমান, মোঃ আক্তার হোসেন, দুর্জয় বড়ুয়া।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ বলেন, তামুক চুলার দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছে ফায়ার সার্ভিসকে, স্কুলের কাছ থেকে সরাতে হবে। তা না হলে অবৈধ তামাক চুল্লিগুলো ভেঙে ফেলবে ফায়ার সার্ভিস। জ্বালানি কাঠ ব্যাপারে বন ও পরিবেশ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

দীঘিনালা ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিলিভ ডিফেন্সের পংকজ বড়ুয়া বলেন, বলেন দিঘীনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদেরকে লিখিতভাবে দায়িত্ব দেননি। মৌখিকভাবে দিয়েছেন। তবুও আমরা ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়েই দেখছি। বন অধিদপ্তরের বনও পরিবেশ দক্ষিণ বিভাগের দাবি, পাহাড়ে গাছ কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ। গাছ কাটার সাথে যারা জড়িত আছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।

তামাক চুল্লিতে দামী কাঠ
তামাক চুল্লিতে দামী কাঠ

এক তামাক চাষী বলেন, একটা তামাক চুলাতে প্রতি মৌসুমে ৮০০ থেকে ১ হাজার মন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে হয়। কাঠগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই দামি কাঠ। অকপটে স্বীকার করে ওই তামাক চাষী বলেন, আম, জাম, গর্জন, সেগুন, কাঁঠাল কাঠসহ বিভিন্ন গাছের কাঠ ব্যবহার করছি।

উল্লেখ্য, দীঘিনালা উপজেলার ৩ নং কবাখালি ইউনিয়নে অবস্থিত ব্রিটিশ টবাকো কোম্পানি কর্তৃক প্রতি বছর তামাক চাষীদের প্রণোদনা দিচ্ছে নিয়মিত। অথচ কোম্পানির পক্ষ থেকে কোন প্রকার নীতিমালা অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়না।

তামাক চাষীদের দাবি, তামাক চুল্লি ব্যবহারে ফায়ার সার্ভিস ও বন বিভাগ কর্তৃক নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।

তামাক চাষীদের চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে গাছের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যাবহারে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে বলে মনে করেন এলাকার সচেতন নাগরিকরা।