ঢাকা ০১:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘ডেড জোন’ কক্সবাজার!

আকাশ ইসলাম
  • সময় ০৫:৩৫:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
  • / 231

বাংলাদেশে গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, যা সাধারণত “বন্দুকযুদ্ধ” নামে পরিচিত, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বেশ আলোচিত হয়েছে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১,১০১ জন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে এমন জেলাগুলোতে, যেখানে মাদক চোরাচালান এবং অন্যান্য অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ব্যাপক উপস্থিতি বিদ্যমান।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, পুলিশের দেওয়া তথ্যে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। তারা মনে করেন, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি বা বেআইনি কার্যক্রম থেকে আসা আয়ের ভাগ নিয়ে বিরোধ এবং রাজনৈতিক স্বার্থ এসব হত্যাকাণ্ডের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

২০২১ সালে র‌্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বন্দুকযুদ্ধের সংখ্যা কমে এসেছে, তবে অপহরণ ও গুমের ঘটনা বেড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনার পেছনে বেআইনি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের যোগসাজশ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের অংশগ্রহণ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে পরবর্তী সাত বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র কক্সবাজারেই বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে ২০৬ জনের। পর্যটন কেন্দ্রসহ সামুদ্রিক অর্থনীতিনির্ভর জেলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি কয়েকটি বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনায়ও বেশ আলোচিত হয়েছে।

কক্সবাজারে ২০১৮ সাল থেকে পরের চার বছরেই মৃত্যু হয়েছে ২০১ জনের। জেলাটিতে সবচেয়ে বেশি বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় ১১৫ জনের।

কক্সবাজার ছাড়াও এ তালিকায় ওপরের দিকে থাকা অন্যান্য জেলা হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, খুলনা ও যশোর। সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মোট নিহতের ৬০ শতাংশেরই প্রাণহানি হয়েছে এ কয়েকটি জেলায়।

গত ১০ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। রাজনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিরও কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে ঢাকা অঞ্চলে। একই সঙ্গে এখানে অপরাধমূলক কার্যক্রমেরও প্রসার ঘটেছে অনেক। পাশাপাশি বেড়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও।

ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪৩ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৩৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরের দুই বছর ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় যথাক্রমে ২৩ ও ২৯ জনের। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ঢাকা জেলায় ১৭ জন করে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫।

‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের পরিসংখ্যানে তৃতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম জেলা। দেশের মোট আনুষ্ঠানিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই পরিচালিত হয় এখানকার চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। এছাড়া তৈরি পোশাক, ইস্পাত শিল্প, গ্লাসসহ দেশের ভারী শিল্পের বড় একটি অংশ গড়ে উঠেছে এখানেই। এর পাশাপাশি পণ্য পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানেরও বড় একটি কেন্দ্র এখন চট্টগ্রাম।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ অঞ্চলকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার কার্যক্রমের বিস্তৃতি বাড়ারও তথ্য পাওয়া গেছে। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। সেখানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৬০ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ১৮ জন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। তার আগের বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৬ জন।

সীমান্তবর্তী জেলা কুষ্টিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৫২ জন। আরেক সীমান্ত জেলা কুমিল্লায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৫০ জন। শিল্পনগরী খুলনায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৪৮ জন। পাশের জেলা যশোর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচারের প্রধানতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে এখানে ৩০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও ময়মনসিংহের মতো জেলাগুলোয় এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মূলত অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে ঘিরেই। কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, কখনো আবার অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতেও এগুলো ঘটানো হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। সেক্ষেত্রে পরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে মাত্রা বেড়েছে অপহরণ ও গুমের।

শেয়ার করুন

‘ডেড জোন’ কক্সবাজার!

সময় ০৫:৩৫:৪৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

বাংলাদেশে গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, যা সাধারণত “বন্দুকযুদ্ধ” নামে পরিচিত, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে বেশ আলোচিত হয়েছে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১,১০১ জন এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে কক্সবাজারে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে এমন জেলাগুলোতে, যেখানে মাদক চোরাচালান এবং অন্যান্য অবৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ব্যাপক উপস্থিতি বিদ্যমান।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, পুলিশের দেওয়া তথ্যে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। তারা মনে করেন, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি বা বেআইনি কার্যক্রম থেকে আসা আয়ের ভাগ নিয়ে বিরোধ এবং রাজনৈতিক স্বার্থ এসব হত্যাকাণ্ডের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

২০২১ সালে র‌্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বন্দুকযুদ্ধের সংখ্যা কমে এসেছে, তবে অপহরণ ও গুমের ঘটনা বেড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনার পেছনে বেআইনি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের যোগসাজশ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যের অংশগ্রহণ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে পরবর্তী সাত বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র কক্সবাজারেই বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে ২০৬ জনের। পর্যটন কেন্দ্রসহ সামুদ্রিক অর্থনীতিনির্ভর জেলাটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি কয়েকটি বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনায়ও বেশ আলোচিত হয়েছে।

কক্সবাজারে ২০১৮ সাল থেকে পরের চার বছরেই মৃত্যু হয়েছে ২০১ জনের। জেলাটিতে সবচেয়ে বেশি বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২০১৯ সালে। ওই বছর জেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় ১১৫ জনের।

কক্সবাজার ছাড়াও এ তালিকায় ওপরের দিকে থাকা অন্যান্য জেলা হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, খুলনা ও যশোর। সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মোট নিহতের ৬০ শতাংশেরই প্রাণহানি হয়েছে এ কয়েকটি জেলায়।

গত ১০ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। রাজনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিরও কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে ঢাকা অঞ্চলে। একই সঙ্গে এখানে অপরাধমূলক কার্যক্রমেরও প্রসার ঘটেছে অনেক। পাশাপাশি বেড়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও।

ঢাকা জেলার বিভিন্ন এলাকায় ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৪৩ জন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৩৪ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পরের দুই বছর ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যু হয় যথাক্রমে ২৩ ও ২৯ জনের। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ঢাকা জেলায় ১৭ জন করে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫।

‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের পরিসংখ্যানে তৃতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম জেলা। দেশের মোট আনুষ্ঠানিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই পরিচালিত হয় এখানকার চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে। এছাড়া তৈরি পোশাক, ইস্পাত শিল্প, গ্লাসসহ দেশের ভারী শিল্পের বড় একটি অংশ গড়ে উঠেছে এখানেই। এর পাশাপাশি পণ্য পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানেরও বড় একটি কেন্দ্র এখন চট্টগ্রাম।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ অঞ্চলকে ঘিরে আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার কার্যক্রমের বিস্তৃতি বাড়ারও তথ্য পাওয়া গেছে। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। সেখানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৬০ জন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ১৮ জন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। তার আগের বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১৬ জন।

সীমান্তবর্তী জেলা কুষ্টিয়ায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৫২ জন। আরেক সীমান্ত জেলা কুমিল্লায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৫০ জন। শিল্পনগরী খুলনায় বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ৪৮ জন। পাশের জেলা যশোর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচারের প্রধানতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে এখানে ৩০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও ময়মনসিংহের মতো জেলাগুলোয় এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মূলত অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে ঘিরেই। কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, কখনো আবার অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিতেও এগুলো ঘটানো হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু এক প্রকার বন্ধ রয়েছে। সেক্ষেত্রে পরে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে মাত্রা বেড়েছে অপহরণ ও গুমের।