ঢাকা ০১:১৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডার্ক সাইট অফ কাপ্তাই লেক

আকাশ ইসলাম
  • সময় ০৬:৫৭:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ জুলাই ২০২৪
  • / 250

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি জেলার এক মনোরম স্থান কাপ্তাই লেক। এই লেকের স্বচ্ছ পানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোনো পর্যটকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তবে এই লেকের পানির নিচে লুকিয়ে আছে এক করুণ ইতিহাস।

১৯৫৬ সাল। আমেরিকার অর্থায়নে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউটাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার বা ২ হাজার ২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১৭৯ ফুট উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এ বাঁধের পাশে ১৬টি গেট রাখা হয়েছে। যেখান থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি বের হতে পারে। প্রকল্পটির জন্য তখন প্রায় ৪৮ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়।

এই লেকের নিচে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের বাড়ি, ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি, ফসল। যা ঐ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। এছাড়া সরকারি সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণিভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়।

এই বাঁধের ফলে স্থানীয় চাকমা এবং মারমা সম্প্রদায়ের লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তাদের পবিত্র স্থানগুলো, বসতি এবং জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

চাকমা রাজার অধীনস্থ রাজবাড়ি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই স্থানান্তরের ফলে প্রায় ১৮ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে নতুন স্থানে পুনর্বাসন করা হয়, যা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং দুর্বিষহ। স্থানান্তরিত হওয়া এসব পরিবার জীবনের মূলধারায় ফিরে আসতে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে গেছে।

পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, লেকটির উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জলসম্পদের উন্নয়ন। প্রথমে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার কিলোওয়াট। প্রথমে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হলেও পরে ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়।

বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে, যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বর্তমানে যেটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার চেয়ে এই উন্নয়নের মানবিক মূল্য ছিল অপূরণীয়।

আবার এই বাঁধের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলা হলেও, এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রধানত শহরাঞ্চল এবং শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়েছিল। ফলে স্থানীয় গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের সুবিধা পৌঁছায়নি। তাই স্থানীয়দের অনেকেই আজও মনে করেন, এই উন্নয়নের জন্য দেওয়া মূল্য ছিল অনেক বেশি।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তটি ছিলো মূলত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের। বলা হয়েছিল- বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্প উন্নয়নে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। তবে তৎকালে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার কিংবা রাজনৈতিক নেতারা এ প্রকল্পের পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি কোনো জোরালো অবস্থান নেননি।

তবে স্থানীয় জনগণ প্রকল্পের আগে এবং পরে অনেকবার প্রতিবাদ করেছে কিন্তু তাদের কষ্ট ও দাবির কথা কেউ শোনেনি। বাঁধ নির্মাণের সময় স্থানীয় জনগণের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের অভিযোগ ছিল, তাদের মতামত বা সম্মতি ছাড়াই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

চাকমা ও মারমা স¤প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব এলাকাকে তাদের ঐতিহ্যবাহী ও পবিত্র স্থান মনে করে। এই অঞ্চলের জনগণ ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার। যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।

শেয়ার করুন

ডার্ক সাইট অফ কাপ্তাই লেক

সময় ০৬:৫৭:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ জুলাই ২০২৪

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি জেলার এক মনোরম স্থান কাপ্তাই লেক। এই লেকের স্বচ্ছ পানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোনো পর্যটকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তবে এই লেকের পানির নিচে লুকিয়ে আছে এক করুণ ইতিহাস।

১৯৫৬ সাল। আমেরিকার অর্থায়নে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউটাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার বা ২ হাজার ২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১৭৯ ফুট উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এ বাঁধের পাশে ১৬টি গেট রাখা হয়েছে। যেখান থেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি বের হতে পারে। প্রকল্পটির জন্য তখন প্রায় ৪৮ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়।

এই লেকের নিচে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের বাড়ি, ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি, ফসল। যা ঐ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। এছাড়া সরকারি সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গমাইল এলাকা ও অশ্রেণিভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়।

এই বাঁধের ফলে স্থানীয় চাকমা এবং মারমা সম্প্রদায়ের লোকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের মোট এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তাদের পবিত্র স্থানগুলো, বসতি এবং জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

চাকমা রাজার অধীনস্থ রাজবাড়ি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই স্থানান্তরের ফলে প্রায় ১৮ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। তাদের বসতবাড়ি ছেড়ে নতুন স্থানে পুনর্বাসন করা হয়, যা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং দুর্বিষহ। স্থানান্তরিত হওয়া এসব পরিবার জীবনের মূলধারায় ফিরে আসতে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে গেছে।

পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, লেকটির উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জলসম্পদের উন্নয়ন। প্রথমে এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ২০ হাজার কিলোওয়াট। প্রথমে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হলেও পরে ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়।

বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে, যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বর্তমানে যেটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার চেয়ে এই উন্নয়নের মানবিক মূল্য ছিল অপূরণীয়।

আবার এই বাঁধের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলা হলেও, এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রধানত শহরাঞ্চল এবং শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়েছিল। ফলে স্থানীয় গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বিদ্যুতের সুবিধা পৌঁছায়নি। তাই স্থানীয়দের অনেকেই আজও মনে করেন, এই উন্নয়নের জন্য দেওয়া মূল্য ছিল অনেক বেশি।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তটি ছিলো মূলত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের। বলা হয়েছিল- বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং শিল্প উন্নয়নে প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে। তবে তৎকালে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার কিংবা রাজনৈতিক নেতারা এ প্রকল্পের পক্ষে বা বিপক্ষে সরাসরি কোনো জোরালো অবস্থান নেননি।

তবে স্থানীয় জনগণ প্রকল্পের আগে এবং পরে অনেকবার প্রতিবাদ করেছে কিন্তু তাদের কষ্ট ও দাবির কথা কেউ শোনেনি। বাঁধ নির্মাণের সময় স্থানীয় জনগণের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তাদের অভিযোগ ছিল, তাদের মতামত বা সম্মতি ছাড়াই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।

চাকমা ও মারমা স¤প্রদায় পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব এলাকাকে তাদের ঐতিহ্যবাহী ও পবিত্র স্থান মনে করে। এই অঞ্চলের জনগণ ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার। যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে।