টেকনাফে বাণিজ্য বন্ধ করেছে মিয়ানমার সরকার
- সময় ০৬:২১:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
- / 29
মিয়ানমারের ইয়াংগুন থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে পণ্য পরিবহনসহ বাণিজ্য সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে দেশটির সরকার। দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ আটকে রাখায় জান্তা সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। যার ফলে টেকনাফ স্থলবন্দর উদ্দেশে রওনা দেওয়া একটি হিমায়িত মাছের জাহাজ সমুদ্রের আকিয়াব থেকে মিয়ানমারে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে।
একাধিক ব্যবসায়ী সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও শনিবার মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম বর্ডার নিউজ এজেন্সিতে সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ রাখার খবর প্রকাশ হয়েছে।
এদিকে, বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার নাফ নদের জলসীমা নাইক্ষ্যংদিয়ায় তল্লাশির কথা বলে পণ্যবাহী তিনটি জাহাজ আটকে দেয় আরাকান আর্মি। চার দিন পর গত সোমবার (২০ জানুয়ারি) দুটি কার্গো জাহাজ ছেড়ে দিলেও এখনও একটি (রবিবার বিকাল পর্যন্ত) আরাকান আর্মির হেফাজতে রয়েছে। যার ফলে দেশটির সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সড়কপথে বাণিজ্য বন্ধ রেখেছে জান্তা সরকার। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই নৌপথে আরাকান আর্মি হস্তক্ষেপ করছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘ইতিমধ্যে ইয়াংগুন থেকে টেকনাফে জাহাজে পণ্য পরিবহনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে জান্তা সরকার। কারণ ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে পণ্যবাহী থেকে আরাকান আর্মি কমিশন নিচ্ছে। সেটি রোধ করতে সাময়িকভাবে পণ্যবাহী বন্ধ করা হয়। এতে দুই দেশে ব্যবসার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাই নিজেদের স্বার্থে এর থেকে উত্তোলনের রেহাই পেতে, দুই দেশের আন্তরিক হওয়া দরকার। না হলে ব্যবসায়ীদের ব্যাপক লোকসানে পড়তে হবে।’
অন্যদিকে এক ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে মিয়ানমারের বর্ডার নিউজ এজেন্সি বলছে, ‘আরাকান আর্মির হাতে আটক পণ্যবাহী কার্গোটি দেশটির প্রভাবশালী উ কিয়াউক তাউংয়ে। তার সঙ্গে দেশটির সেনা কর্মকর্তার সু-সম্পর্ক রয়েছে। তার অনুরোধে জান্তা সরকার সম্ভবত ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরের সীমান্ত বাণিজ্য সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। এর কারণে মিয়ানমার থেকে টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দেওয়া মাছের জলযান মাঝপথ থেকে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে। যাতে আরাকান আর্মিও এ ধরনের কার্যক্রম থেকে দূরে থাকে। একই সঙ্গে তাদের অবৈধ আয় বন্ধ থাকে।’
স্থলবন্দর ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) ইয়াংগুন থেকে একটি মাছের জাহাজ টেকনাফ স্থলবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পরে সেটি আকিয়াব পৌঁছালে সে দেশের সরকার সেটি আবার ফেরত যেতে বাধ্য করে। এই জাহাজে ইলিশসহ প্রায় ১০০ টন মাছ ছিল। সেখানে টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী কায়ছার জুয়েল, ওমর ফারুক, শওকত আলম ও মোহাম্মদ ফারুকসহ অনেকের মাছ ছিল।
এ বিষয়ে মাছ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুফিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী এম কায়সার জুয়েল বলেন, ‘ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসা একটি মাছের জাহাজ আবার ফেরত গেছে। সেখানে আমারসহ আরও অনেকের মাছ ছিল। কিন্তু কী কারণে ফেরত গেছে সেটি পরিষ্কার না। আমি শুনেছি, ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসা আপাতত স্থগিত রয়েছে।’
কয়েকদিন টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ আসা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিন্না অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী শওকত আলী চৌধুরী।
তিনি ইয়াংগুনের ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে বলেন, ‘আপাতত কিছু দিন সেখান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসবে না। একটি মাছের জাহাজ আসার কথা ছিল, সেটিও আর আসতে পারছে না। সেখানকার কিছু সমস্যার কারণে সামায়িকভাবে এ সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।’
ব্যবসায়িক কাজে ইয়াংগুন সফরকারী ব্যবসায়ী ফারুক আলম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমাদের একটি মাছে জাহাজ আবার এখানে (ইয়াংগুনে) ফেরত এসেছে। মূলত ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে আটক পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীদের মাঝে খুব আতঙ্ক কাজ করছে।’
এদিকে রবিবার (২৬ জানুয়ারি) সকালে আরাকান আর্মির দখলে থাকা দুই জাহাজ রাখাইন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছেছে। এ জাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে রাখাইনের মংডুতে সিমেন্ট যাওয়ার কথা রয়েছে।
মংডু থেকে আসা এক জাহাজের নাবিক জামাল বলেন, ‘আসার পথে খালে পণ্যবাহী একটি কার্গো জাহাজ দেখেছি। সেখানে তল্লাশি করছে আরাকান আর্মি। এটি কবে ছেড়ে দেবে সেটি আমার পক্ষে বলা সম্ভব না।’
জানতে চাইলে টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরী ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে বলেন, ‘ইয়াংগুন থেকে টেকনাফ সীমান্ত বাণিজ্য পণ্যবাহী জাহাজের ওপর বিধিনিষেধের কথা শোনা যাচ্ছে- সেটি সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে। আর আরাকান আর্মির হেফাজতে থাকা পণ্যবাহী কার্গোটি দ্রুত মুক্তি পাবে বলে আশা করছি।’
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর জানান, ‘বিষয়টি বিভিন্নভাবে শুনছি। কিন্তু সেটি সে দেশের সরকারের সিদ্ধান্ত কি না সেটি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমরা সে দেশের ব্যবসায়ীরে কাছ থেকে জানার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘১০ দিন পার হলেও এখনও আরাকান আর্মির হেফাজতে থাকা একটি পণ্যবাহী কার্গো ছাড়েনি।’
টেকনাফ কাস্টমস কর্মকর্তা সোহেল উদ্দীন বলেন, ‘আরাকান আর্মি তল্লাশির নামে পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ আটকে রেখেছে। সেটি কবে ছেড়ে দেবে সেটি বলা মুশকিল। আর ইয়াংগুন থেকে জাহাজ না ছাড়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।’
এদিকে গত ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের নিয়ন্ত্রণ নেয় দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। সর্বশেষ ৫ নম্বর সীমান্ত ব্যাটালিয়নটিও দখলে নেয় তারা। এরপর থেকে কোনও পণ্যবাহী জাহাজ মিয়ানমার থেকে টেকনাফে আসেনি। সর্বশেষ ইয়াংগুন থেকে গত ৩ ডিসেম্বর টেকনাফে পণ্যবাহী জাহাজ এসেছিল।